এ-ও এক ‘চার মূর্তি’র গল্প।
নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে। তবে টেনিদা, প্যালারাম, ক্যাবলা, হাবুলের মতো এঁরা কেউ পটলডাঙার রোয়াকে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান না। প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত শিলিগুড়ির রাজনীতি ও ব্যবসার জগতে।
কিন্তু সম্প্রতি নানা কায়দায় উপার্জিত প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা পেট্রোল পাম্পের ব্যবসায় খাটাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ওঁরা। কারণ, রাতারাতি নাকি ওই পেট্রোল পাম্পের হাতবদল হয়েছে। আর নতুন মালিক পুরনো লেনদেনের দায়ভার নিতে রাজি নন। এমন অবস্থায় হাতে ক্ষমতা থাকলেও হারানো টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য নরম বা গরম—কোনওটাই হতে পারছেন না ওই চার জন। বাতিল নোটের এই বাজারে আয়করের রক্তচক্ষু দেখার ভয় যেমন আছে, নেতা-নেত্রীদের কাছে নাকাল হওয়ার আশঙ্কাও নেহাত কম নয়।
তবে ‘তাঁহাদের কথা’ চাপা নেই। যিনি যে দলের ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত, সে দলের কর্মীদেরই কেউ হাসছেন, কেউ ব্যাপারটা দলের প্রদেশ নেতাদের কানে তোলার জন্য কোমর বেঁধেছেন। নেতারাও জানেন ব্যাপারটা। তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেবের মন্তব্য, ‘‘অস্বচ্ছতার ফল ভাল হয় না।’’ জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকারও বলেছেন, ‘‘খবর পেয়েছি। কার টাকা, কোথায় গিয়েছে খোঁজ নিচ্ছি।’’
শাসক দল সূত্রের খবর, দলের অন্দরের হাসি-ঠাট্টায় এক জনকে ‘টেনিদা’র সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। চেহারায় মিল না থাকলেও গল্পের ‘টেনিদা’র মতো তিনিও ভোজনবিলাসী (ডায়াবেটিসে ভুগলেও)। গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে না হলেও অবলীলায় বারবার ভোটে জিতে ‘চ্যাম্পিয়ন’। কিন্তু, কী ভাবে বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছেন, সেই প্রশ্নে নেত্রীর নজরে ‘কোণঠাসা’।
পার্টি অফিসের ঘরোয়া আড্ডায় ‘প্যালারাম’ হলেন শিলিগুড়ির রেলগেটের উত্তর দিকের একটি ওয়ার্ডের শাসক দলের এক নেতা। সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা, (পিলের রোগ না থাকলেও) পেটটা ঈষৎ ফোলা। দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগছেন বলেও শোনা যায়।
‘হাবুল’ কে? রসিকেরা জানাচ্ছেন, সেবক রোডের তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ এক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ীর কথা। পাম্পে লাগানো টাকা ফেরত না পেয়ে যিনি যে কোনও সময় বাঙাল-জবানে ‘খাইসে’ বলে উঠতেই পারেন, এমনই মানসিক দশা তাঁর।
আর ‘ক্যাবলা’র হদিস দিচ্ছেন জেলা কংগ্রেসের একাধিক কর্মী। প্রায় সব সময় সাফারি স্যুট পরে ঘোরা লোকটি ব্যবসাতেও আছেন, সমাজসেবাতেও আছেন। ‘চার মূর্তি’র মধ্যে তাঁকেই সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার বলে জানেন পরিচিতেরা। কিন্তু ওই পেট্রোল পাম্পে টাকা লাগিয়ে তিনিও পড়েছেন বিপাকে।
শিলিগুড়ির ইতিউতি— চায়ের দোকান, পানশালার টেবিল, বা পার্টি অফিসের জটলায় কান পাতলে যে সমস্ত তথ্য উঠে আসছে, সে সব টুকরো জুড়লে গল্পটা এ রকম—কাওয়াখালির কাছে একটি পেট্রোল পাম্প। তার গা ঘেঁষেই মালিকের রেস্তোরাঁ এবং পানশালা। সেই সাজানো ব্যবসায় ‘সাহায্য’ করতেই হাত বাড়িয়ে একলপ্তে টাকা দিয়েছেন ওই চার-জন। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা। নিন্দুকেরা বলছে, বাজার চলতি দরের চেয়ে বেশি হারে সুদ পাওয়ার আশাতেই ওই লগ্নি।
মাস দু’য়েক আগে হঠাৎ ‘চার মূর্তি’ জানতে পারেন, পেট্রোল পাম্প হাতবদল হয়ে গিয়েছে। ছোটাছুটি করে কিছু টাকা আদায় হলেও আগের মালিকের কাছ থেকে পুরো টাকা ফেরত পাননি কেউ। যদিও যাঁকে তাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, সেই ব্যবসায়ী দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘লগ্নি বা সুদে টাকা খাটানোর জন্যা আমাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল, বলাটা ঠিক নয়। অনেকেই নানা সময়ে সহযোগিতা করেছেন। কিছুটা ফিরিয়ে দিয়েছি। বাকিটাও দেব। একটু সময় লাগবে।’’
কিন্তু শোনা যাচ্ছে, ‘সময়-সময়’ করে অনেক কাল কেটে যাওয়ার উদ্বেগে কিছুটা মরিয়া হয়ে পড়েন ‘টেনিদা’। তিনি এই বাজারেও ৫০০, ১০০০-এর নোটে টাকা ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন দেবজ্যোতিকে। বলেছিলেন, ‘‘ও সব নোট চালানোর কায়দা জানা আছে। টাকা ফেরত দাও।’’ অন্য তিন জন তাঁকে ঠেকিয়েছেন। বুঝিয়েছেন, এই মুহূর্তে টাকা চাইতে গিয়ে আয়কর দফতর, থানা-পুলিশ, নেতা-নেত্রী হওয়ার চাইতে চুপচাপ থাকাই ভাল। পুরনো নোট নেওয়ার বদলে ‘হাওয়া ঠান্ডা’ হলে নতুন নোটে প্রাপ্য ফেরত নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। তখন না হয় ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক’ বলা যাবে।
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য