Advertisement
E-Paper

ডাক্তারের জিয়নকাঠিতে প্রাণ পেল স্বাস্থ্যকেন্দ্র

নদিয়ার করিমপুরে বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে গা-ঘেঁষা সেই শিকারপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছবি বদলে দিয়েছেন এক ডাক্তারবাবু। ফের ঝকঝক করছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চত্বর জুড়ে  হরেক ফুলগাছ, বাঁধানো রাস্তা, রোগীদের বসার জায়গা। নিদেনপক্ষে কয়েকশো রোগীর ভিড় হচ্ছে রোজ।

কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৩০
ব্যতিক্রমী: প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসায় শঙ্কর রায়। —নিজস্ব চিত্র।

ব্যতিক্রমী: প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসায় শঙ্কর রায়। —নিজস্ব চিত্র।

বছর সাতেক আগেও ভিটেয় দুপুরে শেয়াল চরত, রাতে চোর-ছ্যাঁচোড় আর মাতাল।

দেখে বোঝাই যেত না, কোনও এক দিন আরোগ্য নিকেতন ছিল এই বাড়ি। না ছিল ডাক্তার, না খুলত আউটডোর। দরজায় তালা, চারদিক ঘিরে ঝোপঝাড়-আগাছা।

নদিয়ার করিমপুরে বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে গা-ঘেঁষা সেই শিকারপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছবি বদলে দিয়েছেন এক ডাক্তারবাবু। ফের ঝকঝক করছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চত্বর জুড়ে হরেক ফুলগাছ, বাঁধানো রাস্তা, রোগীদের বসার জায়গা। নিদেনপক্ষে কয়েকশো রোগীর ভিড় হচ্ছে রোজ।

এ রাজ্যের মানুষ যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে বোঝেন দায়সারা চিকিৎসা আর ছুতোনাতায় ‘রেফার’ করে দেওয়া, শিকারপুর তার এক অনন্য ব্যতিক্রম।

১৯৫৭ সালে বিঘা সাতেক জমির উপরে তৈরি হয়েছিল এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রথম দিকে চালু থাকলেও পরে আর কোনও চিকিৎসক আসতে চাইতেন না। কাঁটাতার থেকে সামান্য তফাতে ফাঁকা মাঠে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হরেক কিসিমের দুষ্কৃতীর অবাধ চারণক্ষেত্র। রাতে বসত মদের আসর।

দীর্ঘদিন খণ্ডহর হয়ে পড়ে থাকার পরে ২০১১ সালে এখানে ডাক্তারি করতে আসেন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের তরুণ শঙ্কর রায়। গোড়ার দিকে তিন মাস ভাড়াবাড়িতে থেকে আবাসন মেরামত করান তিনি। তার পর স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে সেখানে গিয়ে ওঠেন। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। শঙ্করের কথায়, ‘‘আবাসনে গিয়ে থাকতে শুরু করার পরে এক দিন গভীর রাতে দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়। ঘরের দরজা-জানালা ভাঙতে থাকে। পাণ্ডববর্জিত এই জায়গায় পুলিশ আসতে মিনিট চল্লিশ লেগে যায়। তত ক্ষণ তাণ্ডব চলেছে। শেষে পুলিশ আসতে দেখে দুষ্কতীরা পালায়।’’ সেই সঙ্গে বুঝে যায়, এ সহজ লোক নয়।

শঙ্করের বাড়ির লোকজন কিন্তু বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একটু দোনামোনায় পড়েছিলেন তিনিও। তবে পুলিশ, বিএসএফ আর স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা আশ্বাস দেন, আর কিছু হবে না। সেই আশ্বাসেই বুক বেঁধে মাটি কামড়ে নিজের কাজ শুরু করে দেন শঙ্কর। ছবিটা পাল্টে যেতে শুরু করে। পাশে দাঁড়ায় স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক প্রশাসন ও এলাকার সাধারণ মানুষ। খুব তাড়াতাড়ি শিকারপুর আর আশপাশের রোগীরা আবিষ্কার করেন, এ রকম ডাক্তার তাঁরা আগে কখনও দেখেননি।

হোগলবেড়িয়ার সত্তরোর্ধ্ব মন্মথ পালের কথায়, “রোগীরা সাধারণত ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বর নিয়ে যান দরকারে ফোন করবেন বলে। এখানে ডাক্তারবাবুই রোগীদের নাম, রোগের বিবরণ, ফোন নম্বর লিখে রাখেন। মাঝেমধ্যে ফোন করে জানেন, রোগী কেমন আছেন। প্রতি দিন কয়েকশো রোগী আসে। কখনও কাউকে ফেরান না।” আশি বছরের সকিনা বেওয়া বলেন, “ডাক্তারবাবুর এমনই ব্যবহার যে ওঁর কাছে এলে রোগ এমনিতেই অর্ধেক সেরে যায়।’’

ছোট্ট এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছোট-ছোট অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষা হচ্ছে। রোগীদের জন্য পানীয় জল এবং গরম জলের ব্যবস্থা করারও তোড়জোড় চলছে। গুরুতর অসুস্থদের আউটডোর থেকেই বাড়ি পাঠানো বা বড় হাসপাতালে ‘রেফার’এর বদলে যাতে পর্যবেক্ষণে রাখা যায়, তার জন্য দশ শয্যার ওয়ার্ডও চালু করতে চান ডাক্তারবাবু। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলেন, ‘‘সরকারি অনুমোদন পেলে করতে বাধা নেই। কিছু দিন আগে ওঁকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে।’’

শুধু যে শিকারপুর তাঁর প্রেমে পড়েছে তা তো নয়, শঙ্কর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছেন এই প্রান্তিক গাঁয়ের নাড়ির টানে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গা ঘেঁষে জমি কিনে বাড়ি তুলেছেন। ছেলেকে ভর্তি করেছেন শিকারপুর হাইস্কুলে। সে এখন ক্লাস সিক্স। সদ্য চল্লিশ পেরনো শঙ্কর বলেন, ‘‘আমি আর আমার স্ত্রী ঠিক করেছি, এখানেই কাটিয়ে দেব জীবনটা। যদ্দিন পারি, কাজটা করে যাব।’’

Medical Centre Doctor Treatment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy