E-Paper

শ্যামপুরের সেই হারানো ‘ছোট্‌’ ব্রিটেনের গবেষণায়

প্রায় এক মাস ধরে নৌকোটি তৈরির প্রতিটি পর্যায়ের খুঁটিনাটি তথ্য লিপিবিদ্ধ ও ‘ভিডিয়োগ্রাফি’ করেন তিন গবেষক।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ০৯:৩৮
শ্যামপুরে তৈরি ‘ছোট্’।

শ্যামপুরে তৈরি ‘ছোট্’। নিজস্ব চিত্র।

নামে ‘ছোট্’। আকারে ছোট নয়।

এক সময় গভীর সমুদ্রে দ্রুত ছুটত সে নৌকো। মৎসজীবীরা আদর করে নাম দিয়েছিলেন ‘ছোট্‌’। হাওড়ার শ্যামপুরে রূপনারায়ণ নদের ধারে মৎস্যজীবী মহল্লায় ‘ছোট্‌’-এর দেখা মিলত ঘরে-ঘরে। তবে সময়ের স্রোতে বহু বছর আগেই এই নৌকোর ব্যবহার বন্ধ হয়। হারিয়ে যাওয়া এই নৌকা এবং তার নির্মাণশৈলি ফের জনসমক্ষে এনেছেন তিন গবেষক।

ব্রিটেনভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার ‘বিপন্ন উপাদানের জ্ঞান’ (এনডেঞ্জার্ড মেটিরিয়াল নলেজ) প্রকল্পে শ্যামপুরের ‘ছোট্‌’-এর উপরে কাজ করেন ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন কুপার, ব্রিটেনের বাসিন্দা পুরাতত্ত্ব গবেষক জিশান আলি এবং হাওড়ার বাসিন্দা নৌ-শিল্প গবেষক স্বরূপ ভট্টাচার্য। প্রকল্পে যুক্ত ব্রিটিশ মিউজিয়ামও। সে কাজে শ্যামপুরের ডিহিমণ্ডলঘাট এলাকার বর্ষীয়ান নৌ-শিল্পী পঞ্চানন মণ্ডল একটি ‘ছোট্‌’ গড়েন। ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য, নয় ফুট প্রস্থ এবং সাত ফুট গভীরতার নৌকোটি রয়েছে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের হেফাজতে। গুজরাতের লোথালে তৈরি হচ্ছে ‘মেরিটাইম মিউজ়িয়াম’। সেখানেই নৌকাটি স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত হবে।

প্রায় এক মাস ধরে নৌকোটি তৈরির প্রতিটি পর্যায়ের খুঁটিনাটি তথ্য লিপিবিদ্ধ ও ‘ভিডিয়োগ্রাফি’ করেন তিন গবেষক। স্বরূপ জানান, সম্প্রতি সেই সব তথ্য এবং ছবি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে, বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের এই নৌকা নিয়ে বিশ্বের বহু মানুষ জানতে পারবেন।’’

শ্যামপুরের মৎস্যজীবীরা জানান, তাঁদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের নৌকোর মধ্যে সেরা ছিল ‘ছোট্‌’। এই নৌকোর সামনের অংশে অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’-এর আদল। পালে হাওয়া লাগলে জল কেটে দ্রুত ছুটত। মৎস্যজীবীরা বলতেন ‘জলের রাজা’। পণ্যবাহী নৌকা হিসাবেও ব্যবহার হত। শ্যামপুরের দক্ষিণপাড়ায় ঘরে-ঘরে ‘ছোট্‌’ তৈরির কারিগর ছিলেন। ই-মেলে কুপার জানিয়েছেন, ‘‘সমুদ্রে পাড়ি দিতে দক্ষ এই নৌযানের নির্মাণশৈলীই আমাদের আকর্ষণ করে। আমাদের এই প্রকল্পটি ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া নৌ-যানের নির্মাণশৈলী নিয়ে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে আশা করি।’’

স্থানীয় নৌ-শিল্পী ও মৎস্যজীবীদের অভিজ্ঞতা, ‘ছোটে্‌র’ গতি রুদ্ধ হয় রূপনারায়ণে চর পড়ায়। বছর তিরিশ আগে শেষ বার ‘ছোট্‌’ তৈরি করেছিলেন পঞ্চানন। তাঁর দাবি, বর্তমানে গ্রামের আর কেউ ‘ছোট্‌’ বানানোর কৌশল জানেন না। স্বরূপ বলেন, ‘‘এই নৌকোর নির্মাণ পদ্ধতি লিখিত নেই। স্মরণশক্তি দিয়ে পঞ্চাননবাবু যে ভাবে নৌকোটি বানান, বিস্ময়কর!’’ পঞ্চাননের সহকারী ছিলেন তাঁর চার পুত্র।

প্রকল্পটি নিয়ে দেশে-বিদেশের বহু মানুষ আগ্রহ দেখান। আনন্দিত ডিহিমণ্ডলঘাটও। শ্যামপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি নদেবাসী জানা বলেন, ‘‘প্রকল্পের কাজটি প্রশংসনীয়। বিষয়টি এলাকার স্কুলের মাধ্যমে তুলে ধরা যায় কি না, চিন্তাভাবনা করব। এলাকার ঐতিহ্য ছাত্রছাত্রীদের জানা উচিত।’’ নৌ-শিল্পী পঞ্চানন বলেন, ‘‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফের ছোট্‌ তৈরি করতে পারলাম। এটা আমার পরম প্রাপ্তি।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Shyampur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy