এ বার ভোটকেন্দ্রের পরিকাঠামো নির্মাণ নিয়ে টানাপড়েন রাজ্য এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে। সূত্রের খবর, উভয়ের আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত নির্মাণ সংস্থা তথা রাজ্যের পূর্ত দফতরের অধীনস্থ ‘ম্যাকিনটোশ বার্ন লিমিটেড’ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার-বান্ধব পরিকাঠামো নির্মাণের বরাত পেয়েছিল। আচমকা এখন সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছে সংস্থা।
সব ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের গোড়ায় বিধানসভা ভোট ঘোষণা হতে পারে। সেই ভোটে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ এই কাজে সংস্থার এমন অবস্থানকে রাজ্যের ‘অসহযোগিতা’ হিসেবেই দেখছেন কমিশন-কর্তাদের একাংশ। এই অবস্থায় সংস্থাকে কার্যত চরমপত্র পাঠিয়ে জরিমানা, কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) আওতায় সংস্থা-কর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) কার্যালয়।
ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে (এসআইআর) কেন্দ্র করে কমিশন-রাজ্য সংঘাতের আবহে এই ঘটনা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। আবার আর্থিক পরিস্থিতিও এ কাজে অন্তরায় হচ্ছে কি না, তা নিয়েও চর্চা চলছে সমান্তরালে। তবে এমন ঘটনার নজির সাম্প্রতিক অতীতে রয়েছে কি না, তা মনে করতে পারছেন না প্রবীণ আমলাদের অনেকেই।
সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী প্রথমে ফোন ধরে প্রশ্ন শোনার পর ‘হ্যালো হ্যালো’ বলেন। বলেন, শোনা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারও তা-ই। তার পরে ফোন বন্ধ। রাত পর্যন্ত মেসেজের উত্তর দেননি। পূর্তমন্ত্রী পুলক রায় এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ওই সংস্থার তরফেও কোনও মন্তব্য করতে চাওয়া হয়নি।
ভোটের আগে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে উপযুক্ত পরিকাঠামো—যেমন পানীয় জল, প্রবীণ ও বিশেষ ভাবে সক্ষম ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের জন্য ঢালু পথ, ছাউনি, ভোট-কক্ষের প্রয়োজনীয় সংস্কার, দরজা-জানলার সুরক্ষা ইত্যাদি যথাযথ ভাবে তৈরি রাখাই কমিশনের বিধি। প্রতি নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রগুলিতে অস্থায়ী ভাবে এই ব্যবস্থা করা হত ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণ সংস্থার মাধ্যমে। প্রধানত স্কুলগুলিতে ভোটকেন্দ্র হওয়ায়, সেখানে এমন পরিকাঠামো স্থায়ী ভাবে তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল। যুক্তি—একই কাজে প্রতি বার কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হবে না। আবার স্থায়ী ব্যবস্থা থাকলে অন্য সময়ে পড়ুয়া, প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহ অনেকেরই সুবিধা হবে। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, এ নিয়ে অর্থ দফতরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ‘ম্যাকিনটোশ বার্ন’-কে দায়িত্ব দিয়েছিল কমিশন। বলে দেওয়া হয়, ২০১৯, ২০২১ এবং ২০২৪ সালের ভোটে এমন পরিকাঠামো তৈরিতে কত খরচ হয়েছিল তার সমীক্ষা করতে হবে। জানাতে হবে, আগামী বছর বিধানসভা ভোটের জন্য স্থায়ী ভাবে সেই পরিকাঠামোগুলির (যে কাজগুলি হয়ে আছে, সেগুলি বাদ রেখে) নির্মাণে কত খরচ হবে। জেলাস্তরে বিডিও, এসডিও, জেলা শাসকের অনুমোদনের ভিত্তিতে তৈরি হবে খরচের রূপরেখা।
গত ২৮ জুলাই সেই কাজের অনুমোদন পায় সংস্থা। গত ৯ সেপ্টেম্বরের একটি বৈঠকে কমিশন এবং সংস্থার কর্তাদের উপস্থিতিতে কাজের বিধি চূড়ান্ত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ফের চিঠি দিয়ে সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কমিশনের নির্ধারিত বিধি মেনেই কাজ করতে হবে। কিন্তু ১৩ অক্টোবর সিইও কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে সংস্থা জানিয়ে দেয়, এই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারবে না। এই অবস্থায় সংস্থা কর্তৃপক্ষকে সিইও দফতর লিখিত ভাবে জানিয়েছে, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, অবিলম্বে কাজ শুরু করতে হবে। না হলে সংস্থার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ওই আইন বলে পদক্ষেপ হবে। আর্থিক জরিমানা এবং দরকারে কালো তালিকাভুক্তও করা হতে পারে সংস্থাকে। তা দেশের কোথাও কোনও প্রকল্পের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সংস্থার সামনে বাধা তৈরি করতে পারে (সে ক্ষেত্রে বিপুল লোকসানের মুখে পড়বে ওই সংস্থা)। এমনকি, সংস্থার পর্ষদ-কর্তাদের (বোর্ড অব ডিরেক্টরস) বিরুদ্ধে বিএনএস-এর আওতায় ফৌজদারি পদক্ষেপও করতে পারে কমিশন।
প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা, বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রে এই কাজের খরচ হওয়ার কথা রাজ্যের তহবিল থেকেই। তবে অর্থ দফতরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারেরই অধীনস্থ সংস্থা বরাত পাওয়ায় মসৃণ ভাবে কাজ হওয়ার আশা ছিল। আবার বিভিন্ন অনুদানে যে ভাবে সরকার দরাজ হচ্ছে, তাতে অতি প্রয়োজনীয় স্থায়ী ভোট-পরিকাঠামো নির্মাণে অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা নয়। কারণ, অনুদান-অঙ্কের তুলনায় অনেক কম খরচ হওয়ার কথা এই কাজে। তাই প্রায় চার মাস পর সংস্থার হঠাৎ এই অবস্থান অবাক করার মতোই।
এসআইআর-কে নিয়ে রাজ্য-কমিশনের মধ্যে তিক্ততা ক্রমশ বাড়ছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হয়ে কাজ করলেও, সিইও দফতর আদতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনস্থ। আবার সিইও কার্যালয়কে আর্থিক যে কোনও ক্ষেত্রে নির্ভর করে থাকতে হয় রাজ্যের উপরেই। সংশ্লিষ্ট মহলের অনুমান, এসআইআর-বিরোধিতার আঁচে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকতেও পারে। আর মাস-পাঁচেকের মধ্যেই ভোটের সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। ফলে জল কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে বিভিন্ন মহলে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)