Advertisement
E-Paper

অ্যাসিড-হামলার দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ওঁরা

শবনম সুলতানা খান বর্ধমান শহরের বাসিন্দা। ২০১৪ সালে তাঁর উপরে অ্যাসিড-হামলা হয়। তখন তিনি স্নাতক স্তরের পড়ুয়া। ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সঙ্গে চলছে বাস্কেট বল খেলা। ভবিষ্যতে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়েই এগোচ্ছিলেন শবনম। কিন্তু বাদ সাধল ভয়ানক এক ঘটনা।

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০২:৪৭
অ্যাসিড-হামলার পরে শবনম (উপরেবাঁ দিকে)। পাঁচটি অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর এখনকার চেহারা (উপরেডান দিকে)। পুড়ে গিয়েছিল মুখ-সহ শরীরের অনেকটা অংশ (নীচে বাঁ দিকে)। একটি অস্ত্রোপচারের পরে এখন মোজাফ্‌ফর (নীচে ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

অ্যাসিড-হামলার পরে শবনম (উপরেবাঁ দিকে)। পাঁচটি অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর এখনকার চেহারা (উপরেডান দিকে)। পুড়ে গিয়েছিল মুখ-সহ শরীরের অনেকটা অংশ (নীচে বাঁ দিকে)। একটি অস্ত্রোপচারের পরে এখন মোজাফ্‌ফর (নীচে ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

অ্যাসিড-হামলায় ক্ষতবিক্ষত শরীর। নষ্ট হয়ে গিয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। যার জেরে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল ওঁদের। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেনি। তাতে ভর করেই শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে ফের নতুন এক জীবন পেয়েছেন ওঁরা দু’জন। শবনম সুলতানা খান এবং মোজাফ্ফর হোসেন।

কেমন তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি?

শবনম সুলতানা খান বর্ধমান শহরের বাসিন্দা। ২০১৪ সালে তাঁর উপরে অ্যাসিড-হামলা হয়। তখন তিনি স্নাতক স্তরের পড়ুয়া। ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সঙ্গে চলছে বাস্কেট বল খেলা। ভবিষ্যতে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়েই এগোচ্ছিলেন শবনম। কিন্তু বাদ সাধল ভয়ানক এক ঘটনা।

তাঁর পাড়াতেই থাকত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া আয়ান শেখ। আয়ানের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেননি শবনম। আর তার পরিণতি? এক দিন অতর্কিতে অ্যাসিড ছুড়ে আয়ান বিকৃত করে দেয় শবনমের শরীর। পুড়ে যায় মুখ, নষ্ট হয়ে যায় চোখের পাতা। চোখের ভিতরেও ঢুকে গিয়েছিল অ্যাসিড।

সামনেই তখন দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। তার আগে এই অ্যাসিড-হামলায় সব কিছু শেষ হতে বসেছিল শবনমের। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও টলেনি তাঁর মনের জোর। শবনমের কথায়, ‘‘আমার শরীরের ক্ষতি করলেও আমার মন আর আমার মস্তিষ্কের ক্ষমতা তো আগের মতোই রয়েছে। তাই মনে মনে ঠিক করে ফেলি, ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। ঠিক করি, পড়াশোনা চালিয়ে যাব।’’

২০১৪ সালের জুলাই মাসের সেই ঘটনার পরে পাঁচ-পাঁচটি অস্ত্রোপচার হয়েছে শবনমের শরীরের বিকৃতি ঠিক করতে। চোখের দৃষ্টি হারাতে হারাতেও চিকিৎসকেরা কোনও মতে তা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দেশ জুড়ে অ্যাসিড-আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার উদ্যোগে ২০১৬ সালে চেন্নাইয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে যান শবনম। দু’বছরের পড়াশোনা শেষ করে গত ২২ জুলাই এমবিএ পাশ করেছেন তিনি। এখন অপেক্ষা এক নতুন জীবন শুরু করার।

চেন্নাইয়ে পড়তে গিয়ে শবনমের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা মোজাফ্ফর হোসেনের। ২০১৪ সালে শবনমের মতোই প্রায় শেষ হতে বসেছিল ওই যুবকের জীবনও।

ভিন্ ধর্মের এক মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে এক রাতে প্রথমে দলবদ্ধ ভাবে মারধর করা হয় মোজাফ্ফরকে। তার পরে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয় শরীরে। কিন্তু মোজাফ্ফর কোনও মতে বেঁচে যান। কারণ, তাঁর প্রেমিকার ফোন পেয়ে তাঁর দাদা ও প্রতিবেশীরা ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। প্রাণে বাঁচলেও অ্যাসিডে শরীর এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে, তাঁকে দীর্ঘ আট-ন’মাস কলকাতার এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। সেখানেও ভুল চিকিৎসার জন্য পাঁচটা অস্ত্রোপচার করেও তাঁর শরীরের ঘা সারেনি। বরং একটা কান পচে যাওয়ায় সেটি পুরো বাদ দিতে হয়েছে।

কিন্তু তার পরেও হার মানেননি ওই যুবক। বরং মনের জোর আরও বেড়ে গিয়েছে তাঁর। মোজাফ্ফর এমন এক জন মানুষ, যিনি ওই হামলার পরেও নিজের বন্ধু এবং সম্প্রদায়ের লোকজনকে বদলা নেওয়া থেকে বিরত রেখেছেন। পাছে তাঁর প্রেমিকা বা তাঁর বাড়ির অন্যদের ক্ষতি হয়, তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছেন ওই ভয়াবহতাকে। হিংসা নয়, বরং তিনি ভরসা রেখেছেন বিচার ব্যবস্থার উপরে। এ রাজ্যে অস্ত্রোপচার সফল না হওয়ায় চেন্নাইয়ে গিয়ে একটি অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। এখনও বাকি চারটে। এরই মধ্যে চেন্নাইয়ে গিয়ে এমবিএ ডিগ্রি পেয়েছেন তিনি। শবনমের মতো তিনিও রয়েছেন এক নতুন জীবনে প্রবেশ করার অপেক্ষায়।

মোজাফ্ফরের কথায়, ‘‘মাঝে মাঝে রাগ হত। যারা আমার উপরে অ্যাসিড ঢেলে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, ভেবেছিলাম আমিও তাদের দেখে নেব। তার পরে মনে হল, আমি একই কাজ করলে ওদের সঙ্গে আমার আর তফাত কোথায়? ওদের বাড়ির লোকজনও তো আমার মায়ের মতো কষ্ট পাবেন।’’ গত দু’বছরে চিকিৎসার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাঁর সেই অন্য ধর্মাবলম্বী প্রেমিকার। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও ফের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তবে এ রাজ্যের অ্যাসিড-আক্রান্তদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাঁর। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢিলেমি নিয়েও অসন্তুষ্ট তিনি।

Acid Attack Burdwan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy