Advertisement
E-Paper

শুভাপ্রসন্ন কখন ছিলেন, কখন নেই, ঘোর ধন্দে তদন্তকারীরা

যখন তিনি ছিলেন না, তখনও ছিলেন তিনি। যখন তিনি গেলেন, তখনও রয়েই গেলেন। প্রায় ধাঁধাঁর মতো শোনালেও তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন আর তাঁর সংস্থা দেবকৃপা ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড নিয়ে তদন্তে নেমে এমনই বলছেন তদন্তকারীরা। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে এই দেবকৃপাই বিক্রি করেছিলেন শুভাপ্রসন্ন। এই সংস্থার অধীনেই ছিল আলোর মুখ না-দেখা ‘এখন সময়’ চ্যানেল। সিবিআই অফিসারেরা জানাচ্ছেন, ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৈরি হয়েছিল দেবকৃপা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪৭

যখন তিনি ছিলেন না, তখনও ছিলেন তিনি। যখন তিনি গেলেন, তখনও রয়েই গেলেন।

প্রায় ধাঁধাঁর মতো শোনালেও তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন আর তাঁর সংস্থা দেবকৃপা ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড নিয়ে তদন্তে নেমে এমনই বলছেন তদন্তকারীরা।

সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে এই দেবকৃপাই বিক্রি করেছিলেন শুভাপ্রসন্ন। এই সংস্থার অধীনেই ছিল আলোর মুখ না-দেখা ‘এখন সময়’ চ্যানেল। সিবিআই অফিসারেরা জানাচ্ছেন, ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৈরি হয়েছিল দেবকৃপা। তখন শুভাপ্রসন্ন তার সঙ্গে খাতায়কলমে জড়িত ছিলেন না। অথচ কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের সময় তাঁর বাড়ির ঠিকানাই ব্যবহার করা হয়েছিল। অর্থাৎ, যখন তিনি ছিলেন না, তখনও তিনি ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি সংস্থাটি কিনে নেন।

আবার ২০১২ সালে দেবকৃপার সব শেয়ার বেচে দেওয়ার পরে শুভাবাবু এবং তাঁর মেয়ে জোনাকির ডিরেক্টর পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোম্পানি নিবন্ধীকরণ (আরওসি) দফতরের নথি অনুযায়ী, এখনও ডিরেক্টর হিসেবে নাম রয়ে গিয়েছে শুভাপ্রসন্নদের। অর্থাৎ যখন তিনি গেলেন, তখনও তিনি রইলেন।

ধাঁধাই বটে!

এর আগে দু’দফায় শুভাপ্রসন্নকে জেরা করেছে ইডি। মঙ্গলবার প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করল সিবিআই-ও। কিন্তু দেবকৃপা এবং ‘এখন সময়’ চ্যানেল কেনাবেচা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল না। তদন্তকারীদের বক্তব্য, দেবকৃপার যাত্রাপথ কোনও দিনই খুব স্বচ্ছ ছিল না বলেই মনে হয়। সংস্থাটি তৈরি হয় ২০০৬-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি। তখন সংস্থাটির ডিরেক্টর ছিলেন মণীশ ও নন্দিতা জায়সবাল। তাঁদের বাড়ির ঠিকানা ২২, ওয়েস্টন রোড। কিন্তু রেজিস্ট্রেশনের সময় সংস্থাটির ঠিকানা দেওয়া হয়, বিএইচ-১৬৭, সল্টলেক। ওটাই শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যর বাড়ির নম্বর। তিনি সংস্থার কেউ না হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁর বাড়ির ঠিকানায় সংস্থাটি তৈরি হলো, তা স্পষ্ট নয় তদন্তকারীদের কাছে।

সিবিআই সূত্রের খবর, এর পরে ২০০৬ সালের ৮ এপ্রিল অরুণ পোদ্দার ও সঞ্জয়কুমার রাই ডিরেক্টর হিসেবে দেবকৃপায় ঢোকেন। এর ঠিক ২২ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১ মে শুভাপ্রসন্নবাবু ও তাঁর স্ত্রী শিপ্রাদেবী সংস্থার অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেন। ১০ মে মণীশ, নন্দিতা, অরুণ ও সঞ্জয়, চার জনেই ডিরেক্টর পদ ছেড়ে দেন।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দেবকৃপার অনুমোদিত মূলধন (অথরাইজড ক্যাপিটাল) ছিল সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিল দেবকৃপা। মণীশ ও নন্দিতার ১০ হাজার শেয়ার ছিল। অরুণ ও সঞ্জয়ের কোনও শেয়ার ছিল কি না, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। তবে জানা গিয়েছে, শেষমেশ ২০০৮ সালের জুলাই মাসে মণীশ-নন্দিতার শেয়ারও কিনে নেন শুভাপ্রসন্নবাবু ও শিপ্রাদেবী। এর পর ১২টি সংস্থাকে দেবকৃপার শেয়ার বিক্রি করা হয়। ইতিমধ্যে ২০১০ সালের ১০ জুন শিপ্রাদেবী ডিরেক্টর পদ ছেড়ে দেন। তাঁর জায়গায় ঢোকেন তাঁদের মেয়ে জোনাকি ভট্টাচার্য।

কী কাজ ছিল দেবকৃপার? কোনও সংস্থার রেজিস্ট্রেশন করার সময়েই উল্লেখ করতে হয়, ওই সংস্থা কী কী কাজ করবে। দেবকৃপা তৈরির সময় ওই সংস্থা যা যা কাজ করবে বলে নথিভুক্ত হয়েছিল, তাতে কিন্তু চ্যানেল চালানোর কথা নেই বলেই সিবিআই তদন্তকারীদের বক্তব্য। শুভাপ্রসন্নবাবু সংস্থাটি কেনার পরে তাতে কিছুটা পরিবর্তন করলেও চ্যানেল চালানোর কথা লেখা হয়নি বলে তদন্তকারীরা জানান। এ নিয়ে শুভাপ্রসন্নকে প্রশ্ন করা হলে তাঁর দাবি, “অভিযোগ ঠিক নয়। সব ঠিকঠাক আছে।”

তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ২০১২ সালের জুলাই মাসে সুদীপ্ত সেন ‘এখন সময়’ চ্যানেল সমেত দেবকৃপা কিনে নেন। সংস্থার অফিসের ঠিকানা পাল্টে হয় ডিএন ১৪, সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, বিষ্ণু টাওয়ার (১০ তলা)। সুদীপ্তর সঙ্গে সংস্থাটির ডিরেক্টর হন দেবযানী মুখোপাধ্যায়। ওই সময় সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল শুভাপ্রসন্নবাবু ও তাঁর মেয়ে জোনাকির। কিন্তু কোম্পানি নিবন্ধীকরণ (আরওসি) দফতরের নথিতে এখনও নাম রয়ে গিয়েছে দু’জনেরই। কেন এ রকম হলো? শুভাপ্রসন্নবাবুর বক্তব্য, “আমি সব নিয়ম মেনে ইস্তফা দিয়েছি। আরওসি-তেও আবেদন জানিয়েছি। তা ও আমার নাম কেন আছে, সেটা ওঁরা (সুদীপ্ত-দেবযানী) জানেন।”

কিন্তু সুদীপ্ত দেবকৃপা সম্পর্কে অন্য যা তথ্য দিয়েছেন তদন্তকারীদের, তার সঙ্গে শুভাপ্রসন্নর দাবির প্রভূত ফারাক। কী রকম? গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শ্যামল সেন কমিশনে দেওয়া বয়ানে সুদীপ্ত বলেছেন, ওই চ্যানেলটি সারদা ১৫ কোটি টাকায় কেনে। সিবিআইয়ের কাছেও তিনি একই দাবি করেছেন। রাজ্য সরকারের ‘সিট’ সুপ্রিম কোর্টে যে হলফনামা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, সুদীপ্ত ১৪ কোটি টাকা দিয়ে চ্যানেলটি কেনে। কিন্তু শুভাপ্রসন্ন নিজে ইডি এবং সিবিআই-কে অন্য কথা বলছেন। তদন্তকারীদের কাছে তিনি দাবি করেছেন, চ্যানেল বিক্রি করে সুদীপ্তর কাছ থেকে তিনি সাড়ে ৬ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। তার ৬ কোটি টাকাই তিনি তাঁর অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডারদের দিয়েছেন।

অথচ অংশীদারদের একাংশ দাবি করছেন, তাঁরা টাকা পাননি। কারও দাবি, দেবকৃপা যে বিক্রি করা হয়েছে, সেটাই তাঁরা জানেন না। ইডি-র একটি সূত্রের ধারণা, অংশীদারদের কাউকে সুদীপ্ত সেন নিজে সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়েছেন। এই চারটি সম্ভাবনার মধ্যে কোনটি ঠিক বা অংশত ঠিক, তা স্পষ্ট করে বলার সময় আসেনি বলে তদন্তকারীদের মত।

তবে সুদীপ্তর বয়ানে চ্যানেল বিক্রির টাকা কী ভাবে দেওয়া হয়েছিল, তার হদিস কিছুটা মিলেছে। সিবিআই সূত্রের খবর, ঢাকুরিয়ার এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা থেকে টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে জেরায় জানান সারদা-কর্তা। তদন্তকারীরা ২০১২ সালে জুলাই মাসের পর থেকে ওই ব্যাঙ্কে সারদার অ্যাকাউন্টের লেনদেনের নথি খতিয়ে দেখেছেন। সিবিআইয়ের দাবি, ওই অ্যাকাউন্ট থেকে যে ১৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল, তার প্রমাণ রয়েছে। এবং যাঁদের নামে ওই টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই নামগুলি খতিয়ে দেখে তদন্তকারীরা বুঝতে পেরেছেন, দেবকৃপা কেনা বাবদই ওই টাকা খরচ করা হয়েছে। কারা ওই টাকা পেয়েছেন, তা এখনই বলতে চাননি তদন্তকারীরা। যেমন বলতে চাননি, দেবকৃপা বিক্রি সংক্রান্ত ঠিক কী কী নথি জমা দিয়েছেন শুভাপ্রসন্ন।

আপাতত দেবকৃপা নিয়ে এক রাশ প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে তদন্তকারীরা। যেমন, একটি চালু না হওয়া চ্যানেল কিনতে কেন এত টাকা ঢেলেছিলেন সুদীপ্ত, সেটা স্পষ্ট নয়। আরও বিচিত্র বিষয় হলো, চালু না-হওয়া চ্যানেলে মোটা বেতনে চাকরি করেছেন এক তৃণমূল নেত্রী ও এক দাপুটে ছাত্র নেতা। কী কাজের জন্য এত টাকা বেতন দেওয়া হল, তা-ও স্পষ্ট হয়নি।

সব মিলিয়ে সারদা তদন্তে দেবকৃপা যে বড় জট, সেটা মানছেন তদন্তকারীরা। সারদা মামলার আবেদনকারীদের একটি অংশও ইডি এবং সিবিআইয়ের কাছে দেবকৃপা নিয়ে আলাদা অভিযোগ করতে চলেছেন। অন্যতম আবেদনকারী অমিতাভ মজুমদার বলেন, “এই সংস্থাটি অত্যন্ত গোলমেলে। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারদার বহু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলেও এই চ্যানেলটির কোটি টাকার সম্পত্তি কিন্তু এখনও বাজেয়াপ্ত করা হয়নি।”

এ দিন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কলেজ স্ট্রিট শাখায় ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকারের (নিতু) একটি লকার খোলে সিবিআই। অগস্ট মাসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রয়াত কর্তা পল্টু দাসের বাড়িতে লকারের চাবি পাওয়া যায়। এ দিন পল্টু দাসের স্ত্রীর উপস্থিতিতে লকারটি খোলা হয়। তা থেকে নগদ টাকা ও সোনার গয়না পাওয়া গিয়েছে।

sudipto sen cbi probe saradha scam subhaprasanna
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy