E-Paper

বাড়িতে দেহ রেখে দিয়ে গয়না কিনতে শহরে আসে মা-মেয়ে

সকালে কুমোরটুলি ঘাট সাধারণত ফাঁকা থাকে। তাই খুনের পরে ট্রলি ব্যাগে মৃতদেহ ভরে সেখানেই ফেলতে এসেছিল আরতি ও ফাল্গুনী। জেরার মুখে তারা এমনই জানিয়েছে পুলিশকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৮
সুমিতা ঘোষ।

সুমিতা ঘোষ।

বছর তিরিশেক আগে বাগবাজার-কুমোরটুলি অঞ্চলেই থাকত মধ্যমগ্রামে খুনের ঘটনায় ধৃত আরতি ঘোষ। ওই এলাকায় থাকেন তার এক আত্মীয়। সেই বাড়িতে মাঝেমধ্যে যাতায়াত ছিল আরতি ও তার মেয়ে ফাল্গুনীর। সকালে কুমোরটুলি ঘাট সাধারণত ফাঁকা থাকে। তাই খুনের পরে ট্রলি ব্যাগে মৃতদেহ ভরে সেখানেই ফেলতে এসেছিল আরতি ও ফাল্গুনী। জেরার মুখে তারা এমনই জানিয়েছে পুলিশকে। ফাল্গুনীর পিসিশাশুড়ি সুমিতা ঘোষকে (৫০) খুন করার পরে তাঁর দেহটি ট্রলি ব্যাগে ভরে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে মঙ্গলবার সকালে মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে কুমোরটুলি ঘাটে এসেছিল আরতি ও ফাল্গুনী। তবে গঙ্গায় দেহ ফেলার আগেই এলাকার লোকজনের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা চেপে ধরেন মা ও মেয়েকে। আসে পুলিশ। তখনই ট্রলি ব্যাগ খোলা হলে দেহটি উদ্ধার হয় এবং মা-মেয়েকে গ্রেফতার করে উত্তর বন্দর থানা।

পুলিশ জানিয়েছে, তিন জনের মধ্যে সুসম্পর্কই ছিল। এমনকি, কিছু দিন আগে ফাল্গুনীর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সুমিতা। জেরায় তা স্বীকারও করেছে মা-মেয়ে। রবিবার খুনের পরে সোমবার বাড়িতে দেহটি রেখে তারা কলকাতায় এসেছিল। বৌবাজারের একটি সোনার দোকানে গিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার গয়না অর্ডার করে তারা। সেই রসিদ উদ্ধার হয়েছে। এত টাকা তারা কোথায় পেল, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ, আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিল না মা-মেয়ে। তা হলে কি সুমিতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য তারা পেয়ে গিয়েছিল? সেই সম্ভাবনাও রয়েছে। সুমিতার দিদি শিপ্রা ঘোষ বুধবার দাবি করেছেন, সম্পত্তির জন্যই তাঁর বোনকে খুন করা হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি কুম্ভমেলায় যাবেন বলে দিদির শিয়ালদহের বাড়ি থেকে বেরোন সুমিতা। তখন তাঁর গায়ে অনেক গয়না ছিল, যা মৃতদেহে ছিল না বলেই বোনের দাবি। সুমিতারা দশ ভাই-বোন। অসমের জোরহাটে সুমিতার পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, সুমিতা ও ফাল্গুনী, দু’জনই নিঃসন্তান। সুমিতার ব‌্যাঙ্কের লকারে সোনার গয়না রয়েছে। অ্যাকাউন্টে রয়েছে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। সেই সব হাতাতেই তাঁকে খুন করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বুধবার ধৃতদের ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়েছিল। তাদের এক দিনের জন্য জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ঘটনাস্থল যে হেতু মধ্যমগ্রামে, তাই মামলার তদন্তভার মধ্যমগ্রাম থানার হাতে তুলে দেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। আজ, বৃহস্পতিবার তাদের বারাসত আদালতে তুলতে পারে মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, সুমিতার মৃত্যুর আগে তাঁর সঙ্গে ফাল্গুনীর ধস্তাধস্তি হয়েছিল। তার পরেই দেওয়ালে মাথা ঠুকে এবং ইট দিয়ে আঘাত করে সুমিতাকে খুন করা হয়। খুনের পরে ঘরেই দেহটি রেখে দিয়েছিল মা-মেয়ে। দুর্গন্ধ ঢাকতে সুগন্ধি ছড়িয়েছিল তারা। ওই দিন সুমিতারই ট্রলি ব্যাগে দেহটি ভরা হয়। দেহটি ব্যাগে আঁটাতে গোড়ালি থেকে পায়ের অংশ কেটে দেওয়া হয়। তদন্তকারীরা মঙ্গলবার রাতে ফাল্গুনীকে নিয়ে মধ্যমগ্রামের ঘটনাস্থল ওই বাড়িতে যান। সেখানে কোন দেওয়ালে ধাক্কা লেগে সুমিতার মৃত্যু হয়েছে, তা দেখায় ফাল্গুনী। খুনে ব্যবহৃত ইটও পুলিশের হাতে তুলে দেয় সে। ঘর থেকে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা নমুনা সংগ্রহ করেন। পা কাটায় ব্যবহৃত দা-টি জলাশয়ে ফেলা হয়েছিল। সেটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পুলিশের কাছে ফাল্গুনীর দাবি, পা কাটার ও দেহ লোপাটের পরিকল্পনা করেছিল আরতি। তাদের বাড়ি থেকে চারটি মোবাইলও উদ্ধার হয়েছে।

মা-মেয়েকে কুমোরটুলি ঘাটে পৌঁছে দেওয়া ট্যাক্সির চালক শ্যামসুন্দর দাসের দাবি, ট্রলি ব্যাগে যে মৃতদেহ রয়েছে, তা তিনি টের পাননি। ঘাটের কাছে গিয়ে ডিকি থেকে ট্রলি ব্যাগ নামাতে তিনি সাহায্যও করেছিলেন। শ্যামসুন্দর বলেন, ‘‘কী করে বুঝব যে, এত বড় ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে হবে। ভারী ট্রলি ব্যাগ তো অনেকেরই থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই সন্দেহ হয়নি। কোনও দুর্গন্ধও পাইনি। ওঁদের নামিয়ে অন্য যাত্রী তুলে ফিরে আসি দোলতলায়। তার পরে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। ট্যাক্সির মালিক ফোন করে সব জানাতে আমি ও আমার পরিবার ভয় পেয়ে যাই।’’ মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আপাতত ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। শ্যামসুন্দর জানান, ট্রলি ব্যাগ ভারী বলে বাড়তি ১০০ টাকাও নেন। অভিযুক্তেরা তাঁকে জানায়, ট্রলি ব্যাগে কাঁসার বাসন ও জামাকাপড় থাকায় ওজন বেশি। সন্দেহ এড়াতে যাত্রাপথে তারা রান্না নিয়েও আলোচনা করে।

ঘাবড়ে গিয়েছেন ভ্যানচালক রাধানাথ হালদারও। মঙ্গলবার তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বীরেশপল্লির বাড়ি থেকে তাঁর ভ্যানে ট্রলি ব্যাগ চাপিয়ে দোলতলায় পৌঁছয় অভিযুক্তেরা। তিনি জানান, এক জন তাঁকে ফোনে জানায়, দু’জনকে দোলতলায় পৌঁছতে হবে। সেই মতো ফাল্গুনীদের বাড়ি যান তিনি। মা-মেয়ে বেরিয়ে ট্রলি ব্যাগটি ভ্যানে তোলে। দোলতলায় পৌঁছে তাঁকে ১৩০ টাকা ভাড়া দেয় অভিযুক্তেরা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

kumortuli body recovery

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy