Advertisement
E-Paper

অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে সরকারি তকমা, আমানতে বাজিমাত

মহাকরণের মঞ্চে রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের জঙ্গলমহল ও লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য-পরিষেবার সূচনা হয়ে গেল। কয়েকটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুরের হাজারো মানুষকে দেখানো-ও হল। ওই সব তল্লাটে বিশেষ এক সংস্থার খোলা দেড়শো শাখা অফিসের সামনে, এলসিডি স্ক্রিন খাটিয়ে।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৫

মহাকরণের মঞ্চে রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের জঙ্গলমহল ও লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য-পরিষেবার সূচনা হয়ে গেল। কয়েকটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুরের হাজারো মানুষকে দেখানো-ও হল। ওই সব তল্লাটে বিশেষ এক সংস্থার খোলা দেড়শো শাখা অফিসের সামনে, এলসিডি স্ক্রিন খাটিয়ে।

তিন বছর আগের কথা। ২০১১-র ৯ জুলাই। মুখ্যমন্ত্রী সে দিন জঙ্গলমহল ও সন্নিহিত এলাকায় যে স্বাস্থ্য-প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন, তার নাম ‘মেডিটেক।’ আর সেখানে যে সংস্থার অফিসের সামনে এলসিডি পর্দায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছিল, তার নাম সারদা-মেডিটেক। সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠীভুক্ত ওই সংস্থাটিই ছিল প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে। সে দিন পশ্চিম মেদিনীপুর-পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জুড়ে মেডিটেকের দেড়শো অফিসের সামনে জড়ো হওয়া জনতাকে সংস্থার কর্মীরা বুঝিয়েছিলেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সারদা এ বার জঙ্গলমহলে এসে গিয়েছে, রাজ্য সরকারের হয়ে উন্নয়ন করার জন্য।

তিন বছর পরে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত-সূত্রে ‘মেডিটেক’ এখন সিবিআইয়ের আতসকাচের নীচে। কেন?

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন, চার বছর আগে সারদা রীতিমতো চুক্তি করে আইআরসিটিসি-র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। তখন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না-করে কী ভাবে চুক্তিটি হল, তা নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। প্রায় একই ভাবে লিখিতপড়িত চুক্তি না-করেই সারদাকে দিয়ে রাজ্যের তিন জেলায় সমান্তরাল স্বাস্থ্য-পরিষেবা চালিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। যাকে সামনে রেখে সারদা সেখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে বলে তদন্তকারীদের অনুমান।

মেডিটেকের মাধ্যমে সারদা ওখানে কী রকম পরিষেবা দিচ্ছিল?

প্রশাসনিক-সূত্রের খবর: চার জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ডাক্তারের নেতৃত্বে চিকিৎসা-দল গড়া হয়েছিল। ওই চিকিৎসকদের মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন দিত সারদা। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোডে লক্ষাধিক টাকা মাসিক ভাড়ায় একটা বাড়ি নিয়ে প্রকল্পের অফিস চালু হয়। কেনা হয় ১৪টি সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্স। হরিয়ানা থেকে মাসিক দেড় লাখ টাকা ভাড়া-চুক্তিতে একটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাযানও আনা হয়, যার চালক-খালাসির মোট মাসিক বেতন ছিল ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া গাড়িপিছু মাসিক দশ হাজার টাকা ভাড়ায় ১৫টি গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছাতে ৭৫টি মোটরবাইক কিনেছিল সারদা। তাতে চড়ে গিয়ে রোগী খুঁজে আনার জন্য মাসিক তিন হাজার টাকা মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছিল ৭০ জন কর্মীকে। রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পেতেন, যে বাবদ মাসে লাগত প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকার তখন সদ্য ক্ষমতায় এসেছে। জঙ্গলমহলে তখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিষেণজি ও তাঁর দলবল। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে প্রকল্পের সূচনা হতেই মাওবাদী-অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ এলাকায় হইহই করে কাজে নেমে পড়ে সারদা-মেডিটেকের হেল্থ টিম। গড়বেতার বাসিন্দা বিবেকানন্দ দত্তের কথায়, “সারদার লোকেরা বলত, আমরাই সরকারি কর্মী। মুখ্যমন্ত্রী পাঠিয়েছেন।”

বিবেকানন্দবাবুর মতো অনেকে জানিয়েছেন, নিখরচায় ডাক্তার, ওষুধ ইত্যাদি পেয়ে গরিব মানুষ দু’হাত তুলে মুখ্যমন্ত্রী ও সারদার জয়গান করতে শুরু করেন। পাশাপাশি মাওবাদীদের প্রভাবে ভাটার টান ধরে। সারদা’র তথ্য বলছে, জঙ্গলমহলে প্রায় হাজার দেড়েক মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছিল সারদা-মেডিটেক। তাতে ১ লক্ষ ৩২ হাজার রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। কলকাতার গোলপার্কে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মেডিটেক অ্যাকাউন্টের হিসেব অনুযায়ী, প্রকল্পে অন্তত এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি: ব্যাঙ্কের হিসেবের বাইরে আরও প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সুদীপ্ত সেন জেরায় জানিয়েছেন। বাড়তি টাকা নগদে দেওয়া হয়েছিল।

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। ক্রমশ বোঝা যায়, গল্পটা অন্য। কী রকম? সিবিআই-সূত্রের খবর: মুখ্যমন্ত্রী মেডিটেক প্রকল্প চালু করার পরে সারদা জঙ্গলমহলের তিন জেলায় প্রায় সাড়ে বারো হাজার লগ্নি-এজেন্ট নিয়োগ করে। তাদের কাজ ছিল, অবাস্তব সুদের টোপ দিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে টাকা তোলা। সারদা-মেডিটেকের সঙ্গে সরকারের নাম জড়িয়ে থাকায় যে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। স্থানীয় বেশ কিছু আমানতকারী ও এজেন্টের কথাতেও এটা স্পষ্ট। যেমন সারদার চন্দ্রকোনার এজেন্ট পিন্টু আচার্য জানাচ্ছেন, আঠারো মাসে জমা টাকা দ্বিগুণ করার একটা প্রকল্প জঙ্গলমহলে নিয়ে আসে সারদা। “আমানতের ঢল নামে। মুখ্যমন্ত্রী সারদার পিছনে আছেন জেনে লোকে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে সারদায় জমা করেন।” বলছেন পিন্টু। প্রতারণার জাল ছড়াতে থাকে। তাতে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বহু লোক, যাঁদের মধ্যে বহু এজেন্টও আছেন। বাঁকুড়ার রাইপুরের বিদ্যুৎ গুঁই যেমন। তিনি বলেন, “মোটা কমিশনের লোভে সারদার এজেন্ট হয়েছিলাম। আত্মীয়দের বুঝিয়ে কয়েক লাখ টাকা আমানত করি, নিজেও চার লাখ টাকা রেখেছিলাম। গোড়ায় কিছুু ফেরত পেলেও বাকিটা ডুবে গিয়েছে।”

মেডিটেক পা ফেলার পরে জঙ্গলমহলে সারদার লগ্নি-কারবার কতটা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল, সংস্থার এক প্রাক্তন পদাধিকারীর কথায় তার আঁচ মিলেছে। তিনি জানান, ২০১১-র আগে তিন জেলায় সারদার অফিস ছিল সাকুল্যে ১৮টি। আমানত আসত নামমাত্র। কিন্তু মেডিটেক উদ্বোধনের পরে মোট ৬৫টি অফিস গজিয়ে ওঠে। পরবর্তী এক বছরে শুধু এই তিন জেলা থেকে সারদা মোট ১৪৮ কোটি টাকা তুলেছে বলে তাঁর দাবি। খড়্গপুরের এজেন্ট শ্যামল বিশ্বাসের আক্ষেপ, “বলা হয়েছিল, রাজ্য সরকার পাশে আছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে। জনগণের টাকা মার যাওয়ার ভয় নেই। আমরাও মানুষকে তা-ই বুঝিয়েছি। এখন দেখছি, পুরোটাই চক্রান্ত ছিল!”

লগ্নি টানার ‘চক্রান্তের’ চেহারাটা কেমন ছিল, জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকার এজেন্ট ও আমানতকারীদের মুখে তা-ও জানা গিয়েছে। সম্ভাব্য আমানতকারীদের দেখানো হতো, সারদার অ্যাম্বুল্যান্স, যাতে জ্বলজ্বল করছে এমন এক প্রকল্পের নাম, যা কিনা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে চালু হয়েছে! এতেও যাঁরা টাকা রাখতে রাজি হতেন না, তাঁদের অনেককে গাড়িতে চাপিয়ে দুর্গাপুরে সারদা-এজেন্টদের সেমিনারে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া রাজ্যের কয়েক জন মন্ত্রীর ছবি দেখিয়ে ওঁদের ভরসা জোগাতেন কর্তারা। সিবিআই জেনেছে, মেডিটেক চালু হওয়ার পরবর্তী দেড় বছরে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন ও তাঁর ছায়াসঙ্গিনী দেবযানী মুখোপাধ্যায় বেশ ক’বার জঙ্গলমহল সফর করেছিলেন। বলরামপুর, সারেঙ্গা, চন্দ্রকোনা রোড ইত্যাদি জায়গায় সারদার বিভিন্ন অফিসে এজেন্টদের সঙ্গে গোটা তিরিশেক বৈঠক করেন তাঁরা। সেখানে সরকারের সঙ্গে সংস্থার ‘সুসম্পর্কের’ বার্তা দিয়ে এজেন্টদের উদ্দীপ্ত করা হয়।

সরকারকে সামনে রেখে ছড়ানো এ হেন প্রতারণার জালেই আটকে গিয়েছিলেন লাখো মানুষ। বাঁকুড়ার সারেঙ্গার বেলটিকরি গ্রামের দিনমজুর সমীরণ মণ্ডল যেমন, বড় চাষি সুধাকর মণ্ডলও তেমন। সমীরণবাবুর মন্তব্য, “সারদার অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের ছবি দেখিয়ে এজেন্টরা বলত, সারদা হল গিয়ে প্রায় সরকারি সংস্থা। টাকা রাখলে মার যাবে না। ওদের কথায় ভরসা করে বড্ড ভুল করেছি।” এজেন্টদের অনেকের বক্তব্য, একই কায়দায় তাঁদেরও ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। “দুর্গাপুরে আমাদের সঙ্গে মিটিং করতে করতে সুদীপ্তবাবু মাঝে-মধ্যে ফোন হাতে উঠে যেতেন। ফিরে এসে বলতেন, সিএম খোঁজ নিচ্ছিলেন! কোম্পানির ঠাঁটবাট দেখে বিশ্বাসও করেছিলাম।” জানাচ্ছেন সারেঙ্গার এক এজেন্ট। বাঁকুড়ার খাতড়ার এজেন্ট বাবলু পণ্ডার খেদ, “এখন বুঝছি, সব ভাঁওতা। মানুষ এখন আমাদের দুষছেন।” ঝাড়গ্রামের বাঁধগোড়ার এক এজেন্টের স্বীকোরোক্তি, “ওরা বলেছিল, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিয়ে সবাইকে বোঝাতে। এর পিছনে যে এত বড় খেলা রয়েছে, কে জানত?”

এমতাবস্থায় সিবিআই মনে করছে, রাজ্য সরকারের নাম জড়িয়ে জঙ্গলমহলে সারদার স্বাস্থ্য-পরিষেবা চালু এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে তার উদ্বোধন করিয়ে আমজনতার বিশ্বাস অর্জন পুরোটাই একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সারদা-মেডিটেকের খরচের ব্যাপারটা প্রথম নজরে আসে গোলপার্কের ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে। পরে সুদীপ্ত সেন ও তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চক্রান্তের কিছুটা আঁচ মেলে।

মেডিটেক প্রকল্পের গতি শেষমেশ কী হল? সিবিআই অফিসারেরা জানিয়েছেন, সূচনার ক’মাসের মধ্যে তার পাট ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলা হয়। অন্য দিকে রমরমিয়ে চলতে থাকে আমানত সংগ্রহ। মোটরবাইক-আরোহী স্বাস্থ্যকর্মীদের ছাঁটাই করে দু’চাকাগুলো দিয়ে দেওয়া হয় সারদার লগ্নি-এজেন্টদের হাতে।

জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত পথেও দাপিয়ে ছুটতে থাকে প্রতারণার রথ।

সহ প্রতিবেদন: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁকুড়া), দেবব্রত দাস (খাতড়া), কিংশুক গুপ্ত (ঝাড়গ্রাম)

shardha scam ambulance subhashish ghatak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy