Advertisement
E-Paper

তৃণমূলকে ঢুকতে দেবে না ক্রুদ্ধ বামনগাছি

রাত পৌনে আটটায় শববাহী গাড়িটা ঢুকতেই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন এলাকার বাসিন্দারা। মহিলারা কাঁদছেন অঝোরে। পুরুষরাও চোখ মুছছেন অনেকেই। এর মধ্যেই হাতে হাত ধরে শপথ নেওয়া হল। গড়ে উঠল নতুন প্রতিবাদী মঞ্চ। অন্যায়ের প্রতিবাদে এর আগে প্রতিবাদী মঞ্চ দেখেছে উত্তর ২৪ পরগনার সুটিয়া-কামদুনি। এ দিন সেই তালিকায় জুড়ল নতুন নাম। বামনগাছি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৪

রাত পৌনে আটটায় শববাহী গাড়িটা ঢুকতেই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন এলাকার বাসিন্দারা। মহিলারা কাঁদছেন অঝোরে। পুরুষরাও চোখ মুছছেন অনেকেই। এর মধ্যেই হাতে হাত ধরে শপথ নেওয়া হল। গড়ে উঠল নতুন প্রতিবাদী মঞ্চ।

অন্যায়ের প্রতিবাদে এর আগে প্রতিবাদী মঞ্চ দেখেছে উত্তর ২৪ পরগনার সুটিয়া-কামদুনি। এ দিন সেই তালিকায় জুড়ল নতুন নাম। বামনগাছি।

কলেজ পড়ুয়া সৌরভ চৌধুরীর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ‘বামনগাছি প্রতিবাদী মঞ্চের’ সদস্যেরা বললেন, “দুষ্কৃতী তাড়াবই। এ আমাদের শপথ।” তাঁদের সামনে তখন বাইশ বছরের তরুণের টুকরো হয়ে যাওয়া দেহ।

শুক্রবার রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌরভ চৌধুরী। শনিবার সকালে বামনগাছির রেল লাইনে তাঁর খণ্ডবিখণ্ড দেহ মেলে। তার পরই এলাকায় ফেটে পড়েছে জনরোষ। সেই রোষ কখনও রেল অবরোধ করেছে, কখনও বা রাস্তা আটকাতে গিয়ে পুলিশের লাঠি সয়েছে।

এ দিন বিকেলে এনআরএস হাসপাতালের মর্গের সামনে সৌরভের দাদা সন্দীপ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস নেই। তাই সিবিআই তদন্ত চাই।” পুলিশ-সিআইডির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেছেন সৌরভের বাবা সরোজ চৌধুরীও। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সিবিআই তদন্ত চাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, পুলিশের কাছে খুনের অভিযোগ দায়ের করার ৪৮ ঘণ্টা পরেও মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকারকে গ্রেফতার করতে পারেনি তারা। তবে অনুপ তালুকদার নামে শ্যামলের এক শাগরেদ ধরা পড়েছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাবি, পুলিশ খুব ভাল তদন্ত করছে।

এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, শ্যামল এর আগেও খুন ও ডাকাতির অভিযোগে জেল খেটেছে। সে গ্রেফতার না হওয়ায় জনতার ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে শ্যামলের পরিজন-বন্ধুদের উপরেও। এ দিন সকালেই শ্যামলের দিদি পলি কর্মকারের বাড়িতে ভাঙচুর চালান স্থানীয় এক দল যুবক। যদিও শনিবার থেকেই বাড়িছাড়া পলি-রা। বিকেলে কুলবেড়িয়ায় শ্যামলের শাগরেদ সমীর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও হামলা হয়। অভিযোগ, ওই বাড়িতে বোমা বাঁধা হতো। অসামাজিক কাজও হতো। প্রতিবাদে সকাল থেকে দফায় দফায় মিছিল করেন বাসিন্দারা। বামনগাছিতে এ দিন ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছিল বিজেপি ও এসইউসি। দলমতনির্বিশেষে মানুষের সাড়ায় সেটা প্রায় স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধেরই রূপ পায়। দোকানপাট সবই ছিল বন্ধ। বাজার বসেনি। এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই রান্না হয়নি।

প্রথম থেকেই সৌরভের পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্তদের পিছনে শাসক দলের মদত রয়েছে। যদিও শনিবারই সৌরভকে তাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মী হিসেবে দাবি করে বিরাটি কলেজের অধ্যক্ষকে ঘেরাও করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। এ সব দেখে সৌরভের দাদা সন্দীপ জানান, তৃণমূলকে তাঁরা বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। যদিও জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান, তাঁরা সৌরভের বাড়িতে যাবেন। ১১ জুলাই বামনগাছি মোড়ে সভা করবেন তৃণমূলের নেতা মুকুল রায়।

এ দিন সৌরভের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাধা পান কংগ্রেস ও বাম নেতারাও। সকালেই সৌরভের বাড়িতে যান লোকসভা নির্বাচনে বারাসতের কংগ্রেস প্রার্থী ঋজু ঘোষাল। কিন্তু তাঁকে বাড়ির সামনে থেকেই ফিরতে হয়। বিকেলে বামনগাছি যায় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা বামফ্রন্টের একটি দল। তাতে ছিলেন প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী রঞ্জিত কুণ্ডু, সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সৌরভের বাড়িতে ঢোকার মুখে তাঁদের পথ আটকান স্থানীয় কয়েক জন যুবক। স্লোগান ওঠে “শ্যামলকে কে তৈরি করেছে, তার জবাব চাই।” পরে অবশ্য রঞ্জিতবাবু এবং সঞ্জীববাবু সৌরভের বাড়িতে ঢোকেন।

এ দিন সৌরভের বাড়িতে যান বারাসতের বিজেপি প্রার্থী পি সি সরকার ও রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও। রাহুলবাবু বলেন, “সৌরভের মা পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের প্রার্থী ছিলেন। বাবা আমাদের দলের নেতা। তাই এসেছি।” পরে তিনি এনআরএস হাসপাতালের মর্গেও যান। সেখানে তিনি জানান, ভবিষ্যতে বামনগাছিতে যেতে পারে কেন্দ্রীয় দলও। সিটু নেতা সুভাষবাবু এ নিয়ে কিছুটা কটাক্ষ করে বলেন, “রাহুল সিংহ এলে রাজনীতি হয় না, আমরা এলেই হয়!”

তবে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন ঘটনাটিকে রাজনীতির রং থেকে আলাদা রাখার কথাই বলেছেন। তাঁর কথায়, “যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা তো কানে তুলো গুঁজে আছেন। রাজনীতির রং দেখে বিচার করলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে।” বামনগাছি যায় এসএফআই ও ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য নেতৃত্বের একটি প্রতিনিধিদলও। এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায় বলেন, “চোলাই মদের কারবার বন্ধ করার জন্য সোমবার সব থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হবে।”

অরাজনৈতিক প্রতিবাদীরাও সকাল থেকেই সৌরভের বাড়িতে পড়ে ছিলেন। সকালেই সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দারের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে পৌঁছে যায়। বিকেলে যান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, বরুণ বিশ্বাসের বাবা জগদীশ বিশ্বাস, দাদা অসিত বিশ্বাস ও দিদি প্রমীলা রায়বিশ্বাস, বালির হত তৃণমূল নেতা তপন দত্তের স্ত্রী প্রতিমা দত্ত।

এত কিছুর মধ্যে পাথর হয়ে ছিলেন সৌরভের বাবা। বারবার জ্ঞান হারিয়েছেন মা মিতাদেবী। আর সরোজবাবু মাঝে মাঝে শুধু বলে উঠেছেন, “সৌরভ, এলি?” রাতে শববাহী গাড়িতে ছেলে ‘বাড়ি ফেরার’ পরে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি তিনি। সন্তানহারা পিতার আর্জি ছিল, “শেষ বারের মতো ওর মুখটা দেখতে দাও।” দেওয়া হয়নি। কারণ, ওই ছিন্নভিন্ন মুখটি কী করে বাবাকে দেখাবেন সৌরভের বন্ধুরা!

রাতেই রতনবাবুর ঘাটে সৎকার সম্পন্ন হয় সৌরভের।

arunakkha bhattacharya simanta moitro bamangachi saurav chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy