Advertisement
E-Paper

বাংলায় কংগ্রেসের সরকারের বর্ষপূর্তি! কর্মসূচি তো বহু, কিন্তু আন্দোলন-আলোড়ন? শুভঙ্করী অঙ্ক, পাড়ায় পাড়ায় হাত পতাকা

রাজনৈতিক নেতারা কর্মসূচিকে অনেক সময়ে ‘আন্দোলন’ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরাও জানেন নিস্তরঙ্গ, ম্যাড়মেড়ে কর্মসূচি কখনও আন্দোলন হয় না। যে কর্মসূচি আলোড়ন তৈরি করতে পারে না, তাকে আন্দোলন বলে অভিহিত করা যেতে পারে, কিন্তু আসলে তা নয়।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০০
Anniversary of Subhankar Sarkar as WB PCC President

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। —ফাইল চিত্র।

সাড়ে চার দশকের বেশি হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকারে থাকার স্বাদ পায়নি। মাঝে ২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সরকারে শরিক হলেও ন’মাসের মাথায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে মহাকরণ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মনোজ চক্রবর্তীরা। ফলে সেই সরকারে কংগ্রেসের শরিক হওয়া ছিল নেহাতই আনুষ্ঠানিক। ধাতস্থ হতে না-হতেই প্রস্থান। এ হেন পশ্চিমবঙ্গে, এ হেন কংগ্রেসের অন্য এক সরকারের বর্ষপূর্তি সোমবার। তিনি শুভঙ্কর ‘সরকার’। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি।

গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে শুভঙ্করের নাম ঘোষণা করেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে। তার পর ঠিক একটা বছর কাটল। সেই সরকারের নেতৃত্বে বঙ্গের কংগ্রেস এক বছরে কী করল?

খাতা, পরিসংখ্যান, সমাজমাধ্যমের পোস্ট, সংবাদমাধ্যমে জারি করা বিবৃতি বলছে, শুভঙ্করের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এক বছরে ঢেলে কর্মসূচি নিয়েছে। যা পূর্বসূরি অধীর চৌধুরীর কংগ্রেসে ছিল না বলে দাবি কংগ্রেসের নেতাদেরই। তার কারণও রয়েছে। কারণ, অধীর প্রদেশ সভাপতি থাকার পাশাপাশিই ছিলেন বহরমপুরের সাংসদ এবং গত মেয়াদে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা। ফলে তাঁকে বড় সময় দিল্লিতে থাকতে হত। বাংলায় এলেও তাঁর মূল কাজের পরিধি থাকত মুর্শিদাবাদ। যা শুভঙ্করের ক্ষেত্রে নেই। তিনি ভোটে দাঁড়ান না। দাঁড়ালেও হারেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনও জেলা নেই। তাঁর দিল্লির বর্ধিত দায়িত্বও নেই। ফলে কর্মসূচি ডাকা এবং যে ভাবেই হোক তা পালন করার অগাধ সময় এবং বিস্তৃত পরিসর রয়েছে।

প্রদেশ সভাপতি হিসাবে শুভঙ্করের এক বছরকে তাঁর কাছাকাছির কংগ্রেস নেতারা ‘কর্মসূচিময়’ বলে বর্ণনা করছেন। কিন্তু আন্দোলন? আলোড়ন? রাজনৈতিক নেতারা কর্মসূচিকে অনেক সময়ে ‘আন্দোলন’ বলে চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরাও জানেন নিস্তরঙ্গ, ম্যাড়মেড়ে কর্মসূচি আন্দোলন হয় না। যে কর্মসূচি আলোড়ন তৈরি করতে পারে না, তাকে আন্দোলন বলে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শুভঙ্করের এক বছর বঙ্গ কংগ্রেস কর্মসূচিমুখী হলেও আন্দোলন-আলোড়নমুখী হতে পারেনি।

তবে শুভঙ্করের ব্যক্তিজীবনে আন্দোলন এবং আলোড়ন— উভয়ই সরবে বিদ্যমান। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আন্দোলন (সদ্য বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন)। কনিষ্ঠ আলোড়ন (স্কুলপড়ুয়া)।

শুভঙ্কর নিজে কী ভাবে গত এক বছরকে মূল্যায়ন করেন?

প্রদেশ সভাপতির কথায়, ‘‘দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা করেছিলাম, ‘আমি’ নই, ‘আমরা’র দর্শনে কংগ্রেসকে পরিচালিত করব। সেইমতোই চালিয়েছি।’’

সংসদীয় রাজনীতিতে শুভঙ্করের সাফল্য শূন্য। শেষ বার ২০১৬ সালে শ্রীরামপুর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন। কিন্তু রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে দর্শন রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘এখন যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে, ভোটার সংখ্যার নিরিখে যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁরা কংগ্রেসের বিষয়ে কিছু জানেন না। সেই অংশের কাছে কংগ্রেসকে পৌঁছে দেওয়াই চ্যালেঞ্জ।’’

গত এক বছরে রাজ্যের সমস্ত জেলায় সশরীরে পৌঁছেছেন শুভঙ্কর। কলকাতায় থাকলে নিয়ম করে বসেন প্রদেশ কংগ্রেসের সদর দফতর বিধান ভবনে। তাঁর কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই। যা নিয়ে কিঞ্চিৎ শ্লাঘাও রয়েছে তাঁর। তবে পাশাপাশিই বলেন, ‘‘আমি চাইনি। তার মানে এই নয় যে, দিতে চাইলে ‘না’ বলব। বা যাঁদের নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে তাঁদের সমালোচনা করব।’’ শুভঙ্কর জেলায়-জেলায় পৌঁছেছেন ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেসকে কি পৌঁছে দিতে পেরেছেন? কংগ্রেসেরই অনেকে এখনও তাঁদের দলকে ‘মামু (মালদহ-মুর্শিদাবাদ) পার্টি’ বলেই আবডালে ডাকেন। কর্মসূচি বেড়েছে। কিন্তু গুণগত ব্যাপ্তি ঘটেনি। অনেকে মনে করেন, তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘দ্বিমেরু অক্ষ’ (তৃণমূল বনাম বিজেপি)।

সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি হোটেলে প্রদেশ কংগ্রেসের রাজনৈতিক কমিটির সভা হয়েছিল। যেখানে ছিলেন কেসি বেণুগোপাল, গোলাম আহমেদ মীরের মতো সর্বভারতীয় নেতারা। তার পর প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে নির্বাচনী কমিটিরও বৈঠক হয়েছে। শুভঙ্কর অবশ্য তার আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, বিধানসভা ভোটে রাজ্যের ২৯৪টি আসনেই কংগ্রেস প্রার্থী দিতে চায়। যা শুনে কংগ্রেসের অনেক প্রবীণ নেতা ঘরোয়া আলোচনায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ২৯৪ জন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে তো! যদিও একলা চলার কথা সদর্পে বলেও প্রদেশ সভাপতি ‘শুভঙ্করসম্মত’ সতর্কীকরণ দিয়ে রাখছেন— ‘‘রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। কখন কী হয় বলা যায় না!’’

কংগ্রেসের ভোট ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রান্তিক জায়গায় পৌঁছোলেও শতাব্দীপ্রাচীন এই দল তাদের গোষ্ঠীবাজির ঐতিহ্য এই বাজারেও গর্বের সঙ্গে ধরে রেখেছে। তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর শুভঙ্কর সম্পর্কে একটি অভিন্ন পর্যবেক্ষণ রয়েছে— মেদিনীপুরের শুভঙ্কর মুর্শিদাবাদের অধীরের মতো তৃণমূলের বিরুদ্ধে ততটা ‘কড়া’ নন। প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘তৃণমূলের ব্যাপারে কথা বলার ক্ষেত্রে শুভঙ্করদার ভোল্টেজ কম।’’ তবে অনেকের বক্তব্য, আরজি কর থেকে নিয়োগ দুর্নীতি— বিভিন্ন বিষয়ে মমতার সরকারের সমালোচনা করেছেন শুভঙ্কর। ভাষা বা শব্দের ভিন্নতায় অধীরের তুলনায় ‘নরম’ বলা যেতে পারে। কিন্তু তা দিয়ে তো আর ‘বাস্তব’ অবস্থানকে খাটো করা যায় না।

সভাপতিত্বের বর্ষপূর্তিতে শুভঙ্করের মুখে পাড়ায় পাড়ায় কংগ্রেসের পতাকা পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার। ২০১৬ সাল থেকে প্রায় সব বড় ভোটেই বামেদের স‌ঙ্গে জোট করে লড়েছিল কংগ্রেস (২০১৯ সালে ‘সার্বিক ঐক্য’ হয়নি)। শুভঙ্করের কথায়, ‘‘আপামর কংগ্রেস কর্মীদের ইচ্ছা, কংগ্রেস তার শক্তিবৃদ্ধি করুক। আমার শক্তি না-হলে কেউ আমায় পাত্তা দেবে না। সব পাড়ায় কংগ্রেসের পতাকা তখনই ওড়া সম্ভব, যখন সর্বত্র ভোটে লড়ব।’’

প্রাজ্ঞ ভাষাবিদেরা বলেন, বাংলা ভাষায় শুভঙ্করী অঙ্ক বা শুভঙ্করী নামতা বলতে বোঝায় ১৯-এর নামতা। ঐতিহাসিক ভাবে ১৯-এর নামতা মুখস্থ করা কঠিন বলে শিক্ষকেরা এই অঙ্ককে ‘শুভঙ্করী’ নাম দিয়েছিলেন। এটি একদিকে ভয় দেখানোর মতো এবং অন্যদিকে কৌতূহল জাগানোর মতো শব্দ।

যেমন শুভঙ্করের পাড়ায় পাড়ায় হাত পতাকার অঙ্ক। ভীতিজনক এবং কৌতূহলপ্রদ। ‘সরকার’ শুভঙ্কর জানেন তো?

Subhankar Sarkar PCC West Bengal Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy