Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মিলেমিশে থাকতে বলছেন দিদি, দূরে বসে গোমড়া কেষ্ট

শ্যাম রাখি, কেষ্ট রাখি, না কুল রাখি? সঙ্কট যখন এই রকম, তার উত্তরও একটু অন্য রকম! শ্যাম থাক, কেষ্টও থাক। তবে দূরে দূরে থাক! দুর্গাপুরে দলের কর্মী সম্মেলন করতে এসে এই রাস্তাই দেখিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে মঞ্চের মধ্যমণি তিনি, তার একেবারে দূরবর্তী প্রান্তে শুক্রবার দেখা গেল অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডলকে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ডিপ ফাইন লেগ! যে দিকে অপাঙ্গে এক বার তাকিয়ে বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতিকে কিছু নির্দেশ দিলেন তৃণমূূল নেত্রী। সে নির্দেশও নেহাতই অপ্রিয়।

নেত্রীর পাশে নয়, মঞ্চের এক কোণে। দুর্গাপুরের কর্মী সম্মেলনে অনুব্রত মণ্ডল। পাশে মনিরুল ইসলাম। শুক্রবার। ছবি: বিকাশ মশান।

নেত্রীর পাশে নয়, মঞ্চের এক কোণে। দুর্গাপুরের কর্মী সম্মেলনে অনুব্রত মণ্ডল। পাশে মনিরুল ইসলাম। শুক্রবার। ছবি: বিকাশ মশান।

সন্দীপন চক্রবর্তী
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

শ্যাম রাখি, কেষ্ট রাখি, না কুল রাখি? সঙ্কট যখন এই রকম, তার উত্তরও একটু অন্য রকম!

শ্যাম থাক, কেষ্টও থাক। তবে দূরে দূরে থাক!

দুর্গাপুরে দলের কর্মী সম্মেলন করতে এসে এই রাস্তাই দেখিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে মঞ্চের মধ্যমণি তিনি, তার একেবারে দূরবর্তী প্রান্তে শুক্রবার দেখা গেল অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডলকে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ডিপ ফাইন লেগ! যে দিকে অপাঙ্গে এক বার তাকিয়ে বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতিকে কিছু নির্দেশ দিলেন তৃণমূূল নেত্রী। সে নির্দেশও নেহাতই অপ্রিয়। বীরভূমের জেলা রাজনীতিতে তাঁর অপছন্দের কিছু নাম বলে দিয়ে দলনেত্রীর নির্দেশ, “কেষ্ট, এদের সঙ্গে রেখে চলতে হবে তোমায়!” দিদির সামনে মাথা নেড়ে তাঁর দেওয়া তেতো বড়ি বেমালুম হজম করে নিতে হল অনুব্রতকে!

আর এক জন বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান এবং রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সারদা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পর থেকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যাঁকে বলছেন ‘বিবস্ত্র’! ক’দিন আগেই বাঁকুড়ার কর্মিসভায় আগ বাড়িয়ে সারদার প্রসঙ্গ তুলে ফেলেছিলেন শ্যামবাবু। সে দিন দল লজ্জায় পড়েছিল। আর এ দিন বস্ত্রমন্ত্রীর লজ্জা নিবারণ হল কোনও রকমে! মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি আসনের সারিতে সবে জায়গা বেছেছিলেন। দলেরই এক হেভিওয়েট নেতার তৎক্ষণাৎ আপত্তি এখানে কেন? পিছনে যান, পিছনে যান! বিপদ বুঝে বস্ত্রমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে মাঝামাঝি এমন জায়গায় অবস্থান নিলেন, একমাত্র ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলে তবেই যেখানে দলনেত্রীর পক্ষেদেখা সম্ভব!

আপাতদৃষ্টিতে তুুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু তৃণমূলের রাজনীতিতে দলনেত্রীর কাছাকাছি বসা, তাঁর গাড়ির পিছনের আসনে জায়গা পাওয়া এ সবের গুরুত্ব সিপিএমের সেরা ফর্মে পলিটব্যুরোয় ঠাঁই পাওয়ার চেয়েও বেশি! কাজেই কেষ্ট-শ্যামের এ দিনের অবস্থান আপাতত তৃণমূল নেত্রীর খাতায় তাঁদের নম্বর বুঝিয়ে দিয়ে গেল। শ্যামবাবু অবশ্য একটু ধাতস্থ হয়ে গিয়েছেন। সারদা-কর্তার কাছে সিমেন্ট কারখানা বেচে ইডি এবং সিবিআইয়ের কাছে ডাক পাওয়ার পরে কিছু দিন মন্ত্রিসভার বৈঠক এড়িয়ে চলতে হচ্ছিল তাঁকে। দলের শীর্ষ স্তরে মমতা এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, বস্ত্রমন্ত্রীকে তিনি এখনও বিশেষ উচ্চ নজরে দেখছেন না! কিন্তু কেষ্ট? তাঁর দুঃখ দেখে কে!

দলনেত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সম্মেলনের মঞ্চ থেকে এ দিন হনহনিয়ে নেমে গেলেন তিনি। নেমে গেলেন মানে একেবারে উধাও! বীরভূমের কিছু কর্মী ‘ও কেষ্টদা, ও কেষ্টদা’ করে পিছনে ছুটতে গিয়েছিলেন। জেলা সভাপতির চার নিরাপত্তারক্ষীর ধাক্কায় কেষ্ট-ভক্তদের যা অবস্থা হল, তাঁদেরই না অক্সিজেন দিতে হয় এর পরে! ‘কেষ্টদা’র রাগ হোক বা অভিমান, তা অবশ্য একেবারেই স্বাভাবিক। গত ফেব্রুয়ারিতে দুর্গাপুরের এই রাজীব গাঁধী ময়দানেই যুব সম্মেলনে মমতা বলেছিলেন, “কেষ্ট খুব ভাল সংগঠক। তাই কেউ কেউ ওর পিছনে লাগে। আমরা কিন্তু সব কিছুকে মানবিক ভাবে দেখি। কেষ্টর মাথায় অক্সিজেন কম যায়। ওকে অক্সিজেন নিয়ে ঘুরতে হয়।” সে দিন দলনেত্রীর পোডিয়ামের কাছে গদগদ মুখে দাঁড়িয়েছিলেন কেষ্ট।

আর এ দিন? দূরে বসে মাথা নেড়ে দলনেত্রীর কথায় সম্মতি জানাতে হয়েছে তাঁকে। কোন কথায়? না, মমতা বলেছেন, “কেষ্ট সব একা করবে না। একটা কোর গ্রুপ করবে। চাঁদুও থাকবে, আশিসদাকেও রাখবে। সাংসদ-বিধায়কদের নেবে। যখন সংসদ বা বিধানসভার অধিবেশন থাকবে না, শনি-রবিবার দেখে এদের নিয়ে বসবে।” বীরভূমের জেলা তৃণমূলে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ (চাঁদু) যে জেলা সভাপতির লোক আর আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বা সাংসদ শতাব্দী রায়ের সঙ্গে তাঁদের যে বনে না, সেটা বিলক্ষণ জেনেই বেছে বেছে ঠিক সেই নামগুলো উচ্চারণ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “ওর (কেষ্ট) অক্সিজেন সাপ্লাই এখন কমে যাবে। এত লোককে চটিয়েছে, দুধের শিশুরা (বিজেপি এবং তাদের ডাকসাইটে জেলা সভাপতি) ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে! সবাইকে নিয়েই চলা ছাড়া উপায় নেই এখন।”

কেষ্ট বা অন্য কারও নাম না করলেও তৃণমূলের সমস্যা সামলানোর প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক বার্তাটুকু এ দিন সম্মেলনের মঞ্চ থেকে দিয়ে গিয়েছেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। বলেছেন, “পরপর নির্বাচনে এত সাফল্য। হঠাৎ কী এমন হল যে, পরিস্থিতি খুব শক্ত মনে হচ্ছে? আসলে আমরা নিজেরাই সামনের লড়াইটা শক্ত করে তুলছি!” পার্থবাবুর দাওয়াই দু’টো। প্রথমত, দলের পতাকার অসম্মান হয়, এমন কাজে জড়ানো চলবে না। আর দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের দুর্দিনের সৈনিক ছিলেন যাঁরা, তাঁদের সম্মান দিতে হবে দলের অন্দরে।

ঘটনা হল, দলের সুদিনে দলের পতাকার অসম্মান হওয়ার অভিযোগ নিয়েই এ দিন ফিরতে হয়েছে তৃণমূল নেত্রীকে। সম্মেলন ছিল বর্ধমান গ্রামীণ ও শিল্পাঞ্চল, বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া এই পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার কর্মীদের নিয়ে। বৃহস্পতিবার রাতে দুর্গাপুরে এসে এবং এ দিন সকালে সম্মেলনের আগে গেস্ট হাউসে কয়েকটি জেলার নেতাদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠকে বসেছিলেন মমতা। সঙ্গে মুুকুল রায়, পার্থবাবু, সুুব্রত বক্সী ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে দলের রাজ্য নেতৃত্বের কোর গ্রুপ। ডেকে পাঠিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা নেতাদেরও। বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদের কাজকর্ম নিয়ে দলের মধ্য থেকেই একাধিক অভিযোগ হাতে এসেছে তৃণমূল নেত্রীর। জেলা পরিষদ ক্ষমতায় আসার মাত্র ১৩ মাসের মধ্যেই! সংশ্লিষ্ট নেতাদের প্রাথমিক ভাবে সতর্কও করে দিয়েছেন মমতা।

এ সবের জেরেই হোক বা অন্য কারণে, কর্মী সম্মেলনে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলা সভাপতিদের এ বার বক্তৃতা করার ডাক পড়েনি।

শুধু লিখিত রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে তাঁদের। কাজেই ‘কেষ্টদা’র বিখ্যাত বচন শোনার সৌভাগ্য এ দিন আর হয়নি তাঁর অনুুগামীদের। কেষ্ট-ঘনিষ্ঠ এক নেতা অবশ্য বলছিলেন, “দলনেত্রীর কথাই চূড়ান্ত। তিনি যা ভাল বুঝেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দলনেত্রীও জানেন, বীরভূমে দলটা চালাতে দাদাকেই দরকার।”

অন্য একটা প্রসঙ্গে হলেও এ দিনই মমতা বলছিলেন, “রাখে কৃষ্ণ মারে কে, মারে কৃষ্ণ রাখে কে আমি থিওরিটা খুব বিশ্বাস করি!” রাখা এবং মারার জন্য ‘হরি’র জায়গায় ‘কৃষ্ণ’নাম কি নেহাতই কাকতালীয়? কেষ্টই জানবেন হয়তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE