Advertisement
E-Paper

সেই কাজলই এখন কাছের লোক, জল্পনা

গোষ্ঠী রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর নেতার সঙ্গে ‘ঘরোয়া আলোচনা’-র ঠিক পরদিনই জেলার ব্লক-নেতৃত্বকে ডেকে কোন্দল মিটিয়ে এক সঙ্গে কাজ করবার আহ্বান জানালেন অনুব্রত। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘দলে কোনও রকমে কোন্দল চলবে না।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০০:৫১
তৃণমূলের মাথারা। রবিবার বোলপুর পুরসভার অনুষ্ঠান ভবনে শাসকদলের বৈঠক। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

তৃণমূলের মাথারা। রবিবার বোলপুর পুরসভার অনুষ্ঠান ভবনে শাসকদলের বৈঠক। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

গোষ্ঠী রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর নেতার সঙ্গে ‘ঘরোয়া আলোচনা’-র ঠিক পরদিনই জেলার ব্লক-নেতৃত্বকে ডেকে কোন্দল মিটিয়ে এক সঙ্গে কাজ করবার আহ্বান জানালেন অনুব্রত। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘দলে কোনও রকমে কোন্দল চলবে না। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। পনেরো দিন অন্তরে অন্তরে প্রত্যেক বুথ, অঞ্চল ও ব্লক সভাপতিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকা ও দলীয় কর্মীদের নিয়ে মিটিং করতে হবে। কারো সঙ্গে কোন রকম ঝগড়া করা চলবে না। হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। যারা কাজ করতে পারবেন না, তারা দল ছেড়েদিন।’’

শনিবারই বোলপুরে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একই টেবিলে মুখোমুখি আলোচনা করেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁরই বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে পরিচিত কাজল সেখ। গোষ্ঠী রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর এই দুই নেতার বৈঠক নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জেলায় রাজনীতির কারবারিদের মধ্যে জল্পনা। আর তারপরই রবিবার ছিল অনুব্রতর এই বিশেষ বৈঠক। বোলপুর পুরসভার উৎসর্গ অনুষ্ঠান ভবনে ঘণ্টা তিনেক ধরে চলে ওই বৈঠক। বৈঠকে গোটা জেলা থেকে বুথ সভাপতি, অঞ্চল সভাপতি, ব্লক সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সভাপতি, সদস্য, এলাকার বিধায়ক, পঞ্চায়েত প্রধান, পুরসভার পুরপ্রধান ও উপ পুরপ্রধানরা হাজির ছিলেন।

ঘটনা হল, দলের অন্দরেও অনেকে হিসাব মেলাতে পারছেন না। লোকসভা ভোটের পর শনিবার সেই কারণেই দুই বিরোধী গোষ্ঠীর নেতার মুখোমুখি হওয়ার এমন দৃশ্যে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল কারও কারও কাছে। শনিবার সাক্ষী ছিলেন রাজ্যের মৎসমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা, কাজলের দাদা কেতুগ্রামের বিধায়ক সেখ শাহনাওয়াজ, দলের নানুর ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য্য প্রমুখ। অবশ্য এ দিনের এই দৃশ্যের সঙ্গে নানুরে দলের এক সভাকে কিছুতেই মেলাতে পারছেন না আমজনতা থেকে জেলার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষজন। মাসখানেক আগে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সভা হয়ে ছিল নানুরের হাই স্কুল মাঠে। দলেরই একাংশের মতে, সেটি ছিল কাজলকে সমঝে দেওয়ার সভা। কারণ সেদিনের সভায় জেলা সভাপতি অনুব্রত তো বটেই শনিবার তার বাড়িতে আলোচনা উপস্থিত নেতারা তাদের বক্তব্যে (শাহনাওয়াজ ছিলেন না) কেউ সরাসরি আবার কেউ বা পরোক্ষে কাজলকে ‘সমাজবিরোধী’ বলেছিলেন। এও বলেছিলেন, ‘কাজল শেখদের দলে তার জায়গা নেই’।

কী এমন হল, যে একমাসেই বদলে গেল গোষ্ঠী কোন্দল মধুর সম্পর্কে?

জেলার রাজনীতির ঘটনাক্রম বলছে, নানুরে একসময় তৃণমূলের কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল না। বরং প্রথমদিকে সিপিএম বিরোধী লড়াইয়ে বারবার কাজলদের পাপুড়ি গ্রামের বাড়িতে ছুটে গিয়েছেন অনুব্রত। দিনের পর দিন গ্রাম ছাড়া কাজল-শাহনাওয়াজদের বোলপুরে আশ্রয়ও দিয়েছেন। পরবর্তীকালে সেই অনুব্রতর সঙ্গেই দূরত্ব তৈরি হয় কাজলের। মূলত পঞ্চায়েত ভোটের প্রার্থীপদ নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত দু’পক্ষের।

নির্বাচনে ওই সময় টিকিট বিলির দায়িত্বে ছিলেন পর্যবেক্ষক মন্ত্রী মলয় ঘটক। তিনি আগে আবেদনকারীদেরই টিকিট দেওয়ার নিয়ম চালু করেন। দেখা যায় ওই নিয়মের বলে কাজল এবং গদাধর হাজরার (তখন কাজলের সঙ্গেই ছিলেন)মনোনীত প্রার্থীরাই নানুর তো বটেই বোলপুরেও বেশ কিছু পঞ্চায়েতে দলীয় টিকিট পেয়েছেন। যেখানে তারা টিকিট পাননি সেখানে নির্দল হিসাবে গোঁজ দাঁড় করিয়েছেন। গোঁজ দাঁড় করানোর অভিযোগ ওঠে অন্যপক্ষের বিরুদ্ধেও।

ঘটনা হল, নির্বাচনে বোলপুর এবং নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েতে তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিন্দ্বিতায় জিতলেও কিছু কিছু জায়গায় দু’পক্ষের গোঁজ বনাম দলীয় প্রতীকের প্রার্থীদের লড়াই শুরু হয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই হেরে যান অনুব্রতর প্রার্থীরা। এমন কী যে নানুরে বিরোধীরা ত্রিস্ত্রর পঞ্চায়েতে, যেখানে কোনও প্রার্থীই দিতে পারেনি সেখানে জেলা পরিষদের একটি মাত্র আসনে সিপিএম প্রার্থীর কাছে হারতে হয় অনুব্রত অনুগামী দলের হেভিওয়েট নেতা তথা বর্তমান ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যকেও! সে দিনের হারের পিছনে যে কাজলের ‘কলকাঠি’ নাড়া ছিল তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সভাতেই প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন অনুব্রত অনুগামী নেতারা।

নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েত-সহ বোলপুরের ৫ টি পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রন হাতে পান কাজল। ওইসব পঞ্চায়েত এলাকায় কার্যত ব্রাত্য হয়ে পড়ে অনুব্রত অনুগামীরা। তাই দু’পক্ষের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, খুনোখুনির অভিযোগও ওঠে। কিন্তু ১০০ দিনের কাজ, ঠিকাদারী বরাত, বালির ঘাটের দখল-সহ সব জায়গাতেই অনুব্রত অনুগামীদের হটিয়ে জায়গা করে নেয় কাজল অনুগামীরা। কার্যত কোনও কোনও ক্ষেত্রে, মুখ খুলে দল ও দলের প্রদেশ নেতৃত্বকে অস্বস্তির মুখে ফেলে দেয় কাজল।

শনিবার সেই কাজলই বোলপুরে এসে দু’ ঘণ্টার ‘ঘরোয়া আলোচনা’ করলেন কেন, সে নিয়ে জেলার বিরোধী শিবিরে নানা মত। একাংশের মতে, কাজলের শিকড় অনেক দূরে বিস্তৃত। না হলে দিনের পর দিন অনুব্রতকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরও দলে তার একছত্র আধিপত্য থাকার কথা নয়। কারণ জেলা সভাপতির বিষ নজরে পড়ে‌ই ইতিমধেই দল থেকে ছিটকে যেতে হয়েছে দলের জেলা সম্পাদক, লাভপুরের দেবাশিষ ওঝার মতো সিপিএমের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করা বহু নেতাকে। দলেরই একাংশের দাবি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুব্রতকেই কিল খেয়েও তা হজম করতে হয়েছে উপর তলার নির্দেশে। সাম্প্রতিক বিগ্রেডেও দলনেত্রী সব ভুলে বিধানসভা নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই কিল খেয়ে আবারও কিল হজম করতে হল অনুব্রতকে।

সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, ‘‘তৃণমূলের দলীয় ব্যাপার। তাই কিছু মন্তব্য করব না।’’ অন্যদিকে বিজেপি’র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা বলেন, ‘‘তৃণমূলের কাছে এর বেশি আর কিই আশা করা যায়। কিছুদিন আগে যে ছিল সমাজবিরোধী বিধানসভা নির্বাচনে তাকেই হাতিয়ার করতে হল।’’ কী বলছেন কাজল? তাঁর উত্তর, ‘‘ববি হাকিমের নির্দেশে বসে ছিলাম। অনুব্রত বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে প্রার্থী করবে, তাঁকেই লিড ভোটে জেতাব।’’ আর অনুব্রত? ফোন ধরে প্রশ্ন শুনেই বলেন, ‘‘কাজল আমার পাশেই বসে আছে। কাজল তো তৃণমূলই করত, সে তৃণমূলের বাইরে কখনও যায়নি।’’

তাহলে তাকে ‘সমাজবিরোধী’ বলা হয়েছিল কেন? এ প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দেননি অনুব্রত। প্রশ্নের মাঝেই ফোন কেটে দেন।

Anubrata Mandal Kajal Shek Trinamool Blopur Nanur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy