পিছনে দলনেত্রীর ফ্লেক্স ঝোলানো। ঘাসফুলের পতাকায় মোড়া মঞ্চও প্রায় একই রয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন বদলে গিয়েছে কুশীলবদের চরিত্র। এক মঞ্চের নায়ক অন্যত্র গিয়ে হয়ে উঠেছেন খলনায়ক! ঘন ঘন এই পট পরিবর্তন দেখেছে নানুর। নেতাদের রাজনৈতিক কক্ষপথ পরিবর্তনে নানুর তাই হয়ে উঠেছে জেলার রাজনীতির খোরাকও!
তর্ক তপ্ত এই আলোচনার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে অনুব্রত বনাম কাজলের কোন্দল। যার জেরে কখনও তেতে ওঠে নানুরের গ্রাম। কখনও তেতে উঠছে বড় শিমুলিয়া।
শুরুটা সেই ২০১০ সালে। নানুরের পাপুড়ি গ্রামে তৃণমূলের তৎকালীন জেলা সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি শেখ শাহনাওয়াজের ভাই তথা কাজল শেখের দাদা বদ্দিউদজ্জামানের স্মরণসভায় দলবল নিয়ে হাজির দলের বর্তমান জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ওই সভামঞ্চে কাজলকে দলের লড়াকু নেতা বলে আখ্যায়িত করে সে দিন জেলা সভাপতি তাঁকে জেলা যুব সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। দু’বছরের মাথায় একই উদ্দ্যেশে আয়োজিত সভাতে হাজির হননি জেলা সভাপতি। পরিবর্তে তাঁর বিরোধী মেরুতে থাকা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, নুরে আলম চৌধুরী, স্বপন ঘোষ, বিধায়ক গদাধর হাজরাদের দেখা গিয়েছিল মঞ্চে। ঠারে ঠোরে জেলা সভাপতির নাম না করে বিষোদাগারও শোনা গিয়েছিল ওই সব নেতাদের মুখে। বিশেষ করে অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতি নিয়ে সব থেকে বেশি কটাক্ষ শোনা গিয়েছিল গদাধর হাজরার মুখে। সে সময় কাজলকে কার্যত সেনাপতির আসনে বসিয়েছিলেন গদাধরবাবুও।
“রানার জন্যই গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পাছে নানুরে তার প্রাসঙ্গিতা নষ্ট হয় সেই আশঙ্কায়
বিরোধ জিইয়ে রাখতে অনুব্রত মণ্ডলকে নানাভাবে কানভারী করছেন।” —কাজল শেখ।
২০১৫ সালে অবশ্য ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যান গদাধরবাবু। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল-সহ অন্যান্য নেতৃত্বের উপস্থিতিতে নানুরের স্কুল মাঠের প্রকাশ্য সমাবেশে কাজলকে সমাজবিরোধী পর্যায়ভুক্ত করেন তিনি। আর নাম না করে কাজলের উদ্দ্যেশে জেলা সভাপতির বক্তব্যই ছিল, ‘যার কোনও পদই নেই, তাকে বহিষ্কারের প্রশ্নও নেই।’
অথচ এমন ছিল না দিন। এক সময় জেলার অন্যত্র আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীদের সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরা স্রোত বইলেও তাতে গা ভাসাননি নানুরের তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা। বরং একই কক্ষপথে কাজল- শাহনাওয়াজদের সঙ্গে আবর্তিত হয়েছে অনুব্রত মণ্ডলেরও গতি। সে সময় সিপিএমের হামলায় দিনের পর দিন ঘরছাড়া শাহনাওয়াজদের বোলপুরে অন্যতম আশ্রয়দাতা ছিলেন অনুব্রত। রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের বহুবার গ্রামেও ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সিপিএমের হামলায় নিহত বদ্দিউদজ্জামানকে শহিদের মর্যাদা দিয়ে মূলত তিনিই বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সে সব আজ ছবি মাত্র। এক সময় সিপিএমের সঙ্গে সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে নানুর। এখন তৃণমুলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে ফের ঘনিয়ে উঠেছে সিঁদুরে মেঘ। ইতিমধ্যে দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যালয় ভাঙচুর, মারমারি এমনকী খুনেরও অভিযোগ উঠেছে। প্রভাব পড়েছে বোলপুরের এলাকাতেও। সম্প্রতি দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে তেতে উঠেছে বড়শিমুলিয়া গ্রাম।
বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই নানুরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরাস্রোত বইতে শুরু করে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর তা বেআবরু হয়ে পড়ে। এক সময় কাজলের অনুগামী হিসেবে পরিচিত বর্তমানে জেলা সভাপতির গোষ্ঠীতে নাম লেখানো এক প্রাক্তন ব্লক নেতা বলেন, ‘‘দল যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও ছিল না। শাসন ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে গোষ্ঠী কোন্দলও।’’ কেন কোন্দল?
ওই নেতার কথায়, ‘‘শাসন ক্ষমতা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে অর্থের উৎসমুখ খুলে যায়। খুলে যায় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা হাতানোর দরজাও। দাপট অনুযায়ী তা ভোগ করেন নেতারা। ওই ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে গোষ্ঠী বদলের ঘটনাও ঘটে। বর্তমানে নানুরে ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বেশিরভাগ পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি তো বটেই, নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বোলপুরের বেশ কিছু পঞ্চায়েতেও কাজলই শেষ কথা। তার দাপটেই কোন ঠাঁসা হয়ে অনুব্রত শিবিরেই নাম লিখিয়েছেন গদাধর হাজরা, সুব্রত ভট্টাচার্য, অশোক ঘোষদের মতো নেতারা।’’
তাঁদের একজন বলেছেন, ‘‘বামফ্রন্টের আমলে ছড়ি ঘুরিয়েছেন রানা (অভিজিৎ সিংহ)। ফের মাথায় চেপে বসেছে। এটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’’ গদাধরবাবুরা অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘বর্তমানে কাজলের আচরণ দলের নীতির পরিপন্থী। তাই তার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হয়েছে।’’
এক সময় ক্ষমতা দুরের কথা, নানুরে তৃণমূলের তেমন কোনও অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। মূলত ২০০০ সালে সুচপুরে সিপিএমের হাতে ১১ জন দলীয় ক্ষেতমজুরের খুন হওয়ার ঘটনাকে সামনে রেখে নানুর তথা জেলায় তৃণমূলের উত্থান ঘটে। নিহতদের মধ্যে ১০ জনই ছিলেন স্থানীয় থুপসড়া পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা। ওই হত্যাকাণ্ডের সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগিয়ে ২০০৩ সালে তৎকালীন ব্লক সাধারণ সম্পাদক মুন্সী নুরুল ইসলাম ওরফে প্রয়াত সোনা চৌধুরীর নেতৃত্বে ব্যাপক ভাবে থুপসড়া পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল-বিজেপি জোট। ওই বছরই পাপুড়ি যে পঞ্চায়েতের অধীন সেই চারকলগ্রামও শাহনাওয়াজ এবং কাজলের নেতৃত্বে দখল করে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। বেশিদিন পঞ্চায়েত দু’টি ধরে রাখতে না পারলেও তৃণমূল নেতাকর্মী এককাট্টা করে তোলে ক্ষমতা হারানোর জ্বালা। ফলশ্রুতি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে সিপিএমের ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ সত্ত্বেও চণ্ডীদাস নানুর এবং উচকরণ পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনে নির্ণায়কের ভূমিকায় পৌঁছে যায় তৃণমূল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লালদুর্গ হিসেবে খ্যাত নানুর কেন্দ্রে জয়ী হন তৃণমূলের গদাধর হাজরা। তারপরও অনুব্রতর সঙ্গে একমঞ্চে দেখা গিয়েছে গদাধর, শাহনাওয়াজ, কাজলদের। বিরোধ শুরু হয় দলে অভিজিৎ ওরফে রানা সিংহকে ঢোকানোকে কেন্দ্র করে। রানার সমপর্যায়ের বামফ্রন্টের বিভিন্ন শরিক দলের নেতা-কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিলেও নানুরের আদি দলে রানার ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে তীব্র আপত্তি ওঠে। সেই দলে কাজলদের পাশাপাশি ছিলেন বরাবর অনুব্রতর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত বর্তমান ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যও। অল্পদিন পরেই অবশ্য সুব্রতবাবু পুরোপুরি অনুব্রততে আত্মসমর্পন করেন। তার ফলও ভোগ করতে হয় সুব্রতবাবুকে।
গোষ্ঠী কোন্দল নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি অনুব্রত। কাজলের স্পষ্ট জবাব, ‘‘রানার জন্যই গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পাছে নানুরে তার প্রাসঙ্গিতা নষ্ট হয় সেই আশঙ্কায় বিরোধ জিইয়ে রাখতে অনুব্রত মণ্ডলকে নানাভাবে কানভারী করছেন। আর আদি তৃণমূল কর্মীদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। বিধানসভায় গিয়ে ফিরহাদ হাকিমকে বিষয়টি জানিয়ে এসেছি। তিনি উভয়পক্ষকে নিয়ে বসার আশ্বাস দিয়েছেন।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy