Advertisement
E-Paper

অচেনার ভিড়ে হারিয়েছে ধুলো মাখা পা

‘পড়শি’ কথাটা ভাবতে গিয়ে বুঝলাম, এই শব্দটার অস্তিত্ব আমার জীবনে আর নেই বললেই চলে। এক সময়ে ছিমছাম একটা পাড়ায় থাকতাম ঠিকই। কিন্তু এসে পড়েছি জঙ্গলে।

অরিজিৎ সিং

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:২০

‘পড়শি’ কথাটা ভাবতে গিয়ে বুঝলাম, এই শব্দটার অস্তিত্ব আমার জীবনে আর নেই বললেই চলে।

এক সময়ে ছিমছাম একটা পাড়ায় থাকতাম ঠিকই। কিন্তু এসে পড়েছি জঙ্গলে। টুকরো টুকরো করে কাটা আকাশ আর লম্বা-লম্বা বাড়ির জঙ্গল। অচেনা, অজানা মানুষের ভিড়।

এক সময়ে আমার পড়শি ছিলেন অদ্ভুত এক জন মানুষ, দরকার হলেই যাঁকে দেখা যেত। নিঃশব্দে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আবার অনেক সময়ে অনায়াসে আমাদের জিনিসে অধিকার ফলাতেন। হঠাৎ হেঁকে ‘‘আজ কী রান্না হয়েছে গো... মাংস!’’ বলে কিংবা জানালার পর্দা সরিয়ে আমাদের ঘরের টিভিতে তাঁর পছন্দের অনুষ্ঠান দেখার আবদার জানাতেন!

ভাবতে ভাল লাগে যে এই রকম কিছু বসন্তের দুপুর, শীতের সন্ধে কাটিয়েছি। সদ্য পরিষ্কার করে মোছা ঘরটায় ঢুকে পড়ল এক পড়শির ধুলো মাখা পা। কিংবা সকালে বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পরে চুপ করে মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া— পড়শিদের কারও কারও চেনা অভ্যেস ছিল এগুলো। সেটাই বোধহয় ভাল ছিল।

এখন তো থাকি অনেক দূরে। কিছু মানুষের সান্নিধ্য হয়তো আছে, এই মুম্বই শহরে। কিন্তু যদি যখন-তখন লোডশেডিং না হয়, টোম্যাটো আর আলু সেদ্ধ দিয়ে মুড়ি না-মাখা হয়, ছাদে বসে পাড়ার অন্য লোকেদের নামে নিন্দে-মন্দ না করা যায়, আমার মতো গেঁয়োর মনে দাগই কাটে না ‘পড়শি’ শব্দটা। যেখানে এখন থাকি, বন্ধুর মতো অনেকেই আছে, কিন্তু ছোটবেলার ঘরের পাশেই আরশিনগর আর সেখানে বসত করা পড়শিরা— যেন স্বপ্ন!

আমার সেই জিয়াগঞ্জের একটা গল্প বলি। কে না জানে, পড়শির স্বভাবই পরোপকার করা। সে দেখিয়ে হোক বা সহজাত ভাবে, উপকার তাঁরা করবেনই। মাত্রাতিরিক্ত উপকার করতে গিয়ে যদি অপকারও করে ফেলেন, তবু করবেন।

মায়ের তখন খুব শরীর খারাপ। বারবার কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এক দিন পরপর ট্রেনে পাঁচ ঘণ্টা যাতায়াত মা সহ্যও করতে পারছিলেন না। তাই এক বার ডাক্তারের কাছ থেকে বেশি দিনের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখিয়ে নেওয়া হল। এক মাসের ওষুধ, মা খেতে শুরু করলেন। স্বাভাবিক ভাবেই নিয়মমাফিক চেক-আপটাও আর করা হল না ওই মাসে।

এর মধ্যেই এক দিন মায়ের শরীর খুব খারাপ। বাবাও বাড়িতে নেই। ফলে আমাকেই যেতে হবে ওষুধ কিনতে। বাড়ি থেকে বেরোতেই এক পড়শির সঙ্গে দেখা। ওষুধের দোকানে কাজ করত সে। আগ বাড়িয়ে প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধের নামগুলো বলে দিল। আমি একটা লেখা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করায় আদ্যোপান্ত ভেবে বলল, ‘ANOID ORGUS.’ সব ওযুধ পেয়ে গেলেও ওই ওষুধটা কিছুতেই পেলাম না। অগত্যা যা ছিল তা দিয়েই কাজ চলল।

কিন্তু ‘ANOID ORGUS’ নিয়ে খচখচানি আমার থেকেই গেল। সন্দেহ আরও বাড়ল যে দিন সকালে উঠে দেখলাম মায়ের মুখে অ্যালার্জি মতো বেরিয়েছে। অ্যালার্জি সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ল— ঠোঁটে, চোখে, নাকের ভেতর, গলায়। মায়ের কষ্ট বেড়ে চলল। কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছিল না। সকালে দেখতাম, মা কলপাড়ে বসে আঠার মতো সেঁটে যাওয়া ঠোঁট গরম জলে ধুয়ে স্বাভাবিক করতেন। রক্তও বেরোত।

মাকে কোনও দিন এমন দেখিনি। ছাদে-বাথরুমে লুকিয়ে কাঁদতাম। শেষমেশ মাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার দেখে বললেন, ‘‘এটা ORANGE-এর সাইড এফেক্ট। আমি তো প্রেসক্রিপশনে AVOID ORANGE লিখেছিলাম!’’ মা লেবু ভালবাসত। বুঝলাম, পড়শির জ্ঞানের দৌলতে ‘AVOID ORANGE’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ANOID ORGUS’!

এই সময়েই কিন্তু আর এক পড়শিকেও পেয়েছিলাম অন্য রূপে।

মা হাসপাতালে থাকতে না চাওয়ায় বাড়িতেই আনা হয়েছিল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না। তখন এলেন বেলাপিসি। এত দিন বেলাপিসিকে আমরা বিশেষ পছন্দ করতাম না। সবার বাড়ি গিয়ে খালি জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘আজ কী রান্না হয়েছে গো... মাংস!’’ কিন্তু নিজে নিরামিশাষী ছিলেন। সারা পাড়া খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতেন। যখন-তখন সাফসুতরো ঘরে কাদা পায়ে ঢুকে পড়তেন। রাস্তার ধারের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে হাতে ধূপকাঠি নিয়ে লুকিয়ে টিভিতে রামায়ণ দেখতেন।

৮৩ বছরের সেই বেলাপিসিই কিন্তু দু’মাস আমাদের হেঁশেলের হাল ধরলেন। সঙ্গে মায়ের ওষুধ দেওয়া, হাত-পা টিপে দেওয়া, বোনকে ঘুম পাড়ানো, আমাদের খাবার দেওয়া— সব করতেন। তবে রাতে থাকতেন না। কত বার খেতে, থাকতে বলেছি আমরা। কিন্তু শুনতেন না। খুব আফশোস হতো। এক সময়ে মনে মনে কী না বলেছি এই মানুষটাকে!

বেলাপিসি অবশ্য এ সবের ধার ধারতেন না। টিভিতে চৈতন্য মহাপ্রভু দেখতে-দেখতে কেঁদে-কেটেই খুশি ছিলেন তিনি। মনে হয় কত সরল, নির্বিবাদী, নির্ভেজাল মানুষ ছিলেন পড়শি এই মানুযটি। এখন অবশ্য তাঁকে আর দেখা যায় না।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy