Advertisement
০৬ মে ২০২৪
শ্রীনু হত্যায় ধৃত ৭

৪ জন ‘সুপারি কিলার’কে ৮ লক্ষ টাকা দিয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছিল

গুলি-বোমার ধোঁয়ায় তখন চারপাশ ঢেকে গিয়েছে। রেলমাফিয়া শ্রীনু নায়ডুকে মারতে আসা দুষ্কৃতীরা সেই ধোঁয়ায় ঠাওর করতে পারেনি, নিজেরাই নিজেদের দলের একজনের হাতে গুলি চালিয়ে দিয়েছে। গুলিবিদ্ধ সেই আততায়ী গিয়ে উঠেছিল ঘাটালের দ্বন্দ্বিপুরে এক নার্সিংহোম কর্মীর বাড়িতে। বরুণ ঘোষ নামে সেই নার্সিংহোম কর্মী গজ-তুলো-স্যালাইন কিনে গুলি বের করার তোড়জোড়ও করেছিল। কিন্তু পারেনি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৩
Share: Save:

গুলি-বোমার ধোঁয়ায় তখন চারপাশ ঢেকে গিয়েছে। রেলমাফিয়া শ্রীনু নায়ডুকে মারতে আসা দুষ্কৃতীরা সেই ধোঁয়ায় ঠাওর করতে পারেনি, নিজেরাই নিজেদের দলের একজনের হাতে গুলি চালিয়ে দিয়েছে। গুলিবিদ্ধ সেই আততায়ী গিয়ে উঠেছিল ঘাটালের দ্বন্দ্বিপুরে এক নার্সিংহোম কর্মীর বাড়িতে। বরুণ ঘোষ নামে সেই নার্সিংহোম কর্মী গজ-তুলো-স্যালাইন কিনে গুলি বের করার তোড়জোড়ও করেছিল। কিন্তু পারেনি।

এই ঘটনাই পুলিশের কানে ওঠে। তারপর বরুণকে পাকড়াও করে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শ্রীনু-খুনের কিনারা প্রায় করেই ফেলল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ। শুক্রবার পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রকাশ্যে আনা হয়েছে চারজনের নাম— শঙ্কর রাও, নন্দ দাস, বরুণ ঘোষ ও রাজেশ সাউ। বেশ কিছু অস্ত্রও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ শুক্রবার বলেন, ‘‘শঙ্করই মূলচক্রী। ঘটনার দিন শালিমারে বসে পুরো ‘অপারেশন’টা দেখভাল করেছে সে। কে, কোথায় থাকবে ঠিক করেছে। যাদের ধরেছি, তারাও এ কথা স্বীকার করেছে।’’ পুলিশ সুপার আরও জানান, ধৃত ৭ জনের মধ্যে ৪ জন-সহ ঘটনাস্থলে ১১ জন ছিল। বাকিদের খোঁজ চলছে।

পুলিশ জেনেছে, জামশেদপুর থেকে মোট ৪ জন ‘সুপারি কিলার’কে ৮ লক্ষ টাকা দিয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। গোটা ছকটা কষতে তিন-চার বার বৈঠকেও বসে দুষ্কৃতীরা। পুলিশ সুপার বলেন, “কতগুলো বড় বড় মাথা, রাজ্যের বাইরে গিয়ে প্রথম মিটিং করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিটিং হয় খড়্গপুরে। একটা মিটিং ৮ জানুয়ারি জন ফ্রান্সিস নামে খড়্গপুরে একজনের বাড়িতে হয়। ওটাই শেষ মিটিং।’’ এরপর খড়্গপুরের কিছু ছেলে জামশেদপুরে গিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে আসে। তারপর বুধবারের ওই ‘অপারেশন’।

কেন খুন করা হল শ্রীনুকে?

ভারতীদেবীর জবাব, ‘‘শ্রীনুর সঙ্গে শঙ্করের পুরনো শত্রুতা ছিল। তাছাড়া, দেড়-দু’বছর শ্রীনুর নামে তেমন অভিযোগ পুলিশ পায়নি। আস্তে আস্তে মাফিয়াগিরি ছেড়ে সে একটা যুব নেতার ভূমিকা নিচ্ছিল। ব্যবসা করছিল। তাই কিছু পুরনো শত্রু এবং কিছু নতুন মাথা এক জায়গায় হয়ে ঠিক করে যে শ্রীনুকে আর বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়।”

শ্রীনু হত্যায় আরও ‘বড় মাথা’ জড়িত থাকার আশঙ্কাও করছে পুলিশ। ভারতীদেবী বলেন, ‘‘এই ঘটনার পিছনে যারা মাথা, তাদের এক-এক করে গ্রেফতার করব। অন্য রাজ্যে গিয়েও ধরতে পারি।” পুলিশ সুপারের মতে, শ্রীনুকে মারলে খড়্গপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হবে। আর সেই মাৎস্যন্যায়ের সুযোগে অনেক ছোট-বড় গুন্ডা মাথা তুলতে পারবে, এমনটাই চেয়েছে শ্রীনু-খুনের পান্ডারা।

তৃণমূল এই ঘটনায় বিজেপি-র দিকে আঙুল তুলেছে। তবে এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘তদন্তের স্বার্থে এ নিয়ে কিছু বলছি না। শুধু বলতে পারি ঘটনার পিছনে বড় বড় মাথা রয়েছে। মাথা কে কে ছিল, কে কে পিছন থেকে সহযোগিতা করেছে, কে কে আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করেছে, ধৃতেরা সব বলে দিয়েছে।”

তবে রাজনৈতিক যোগ ছাপিয়েও শ্রীনু-খুনে বড় হয়ে উঠেছে মাফিয়া দুনিয়ায় বদলার খেলা। আর সেই সূত্রেই উঠে আসছে এক সময় খড়্গপুরের ‘মুকুটহীন রাজা’ বাসব রামবাবুর নাম। রামবাবু জেলে থাকাকালীনই খড়্গপুরের নতুন ‘ডন’ হিসেবে উঠে আসে শ্রীনু। যে শঙ্করকে খুনের মূল চক্রী বলে দাবি করছে পুলিশ, সে-ও রামবাবুর ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ দিন শ্রীনুর শেষ যাত্রায় সামিল তার স্ত্রী পূজা নায়ডু এবং মা রাবণাম্মাও আঙুল তুলেছেন রামবাবুর দিকে। পূজা বলেন, “শ্রীনুকে অনেকেই সহ্য করতে পারত না। এদের সবার উপরে রয়েছে রামবাবু।” রাবণাম্মার কথায়, “বছর চার-পাঁচেক আগে রামবাবু আমাকে ফোন করে শ্রীনুকে ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিতে বলে। না হলে একদিন ছেলেকে শেষ করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল।”

পুলিশ রামবাবু প্রসঙ্গে কিছু বলতে নারাজ। তবে শ্রীনু-খুনে প্রতিহিংসার তত্ত্ব গুরুত্ব পাচ্ছে তদন্তে। তদন্তকারীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, খুনের মূল চক্রী শঙ্করের উপরে ২০১৫ সালে খড়্গপুরে পুরভোটের মুখে হামলার অভিযোগ উঠেছিল শ্রীনুর বিরুদ্ধে। শঙ্করও এর আগে দু’বার শ্রীনুর উপর হামলা চালিয়েছিল। আর এক ধৃত খড়্গপুরের বাসিন্দা নন্দ দাসের সঙ্গেও শ্রীনুর পুরনো শত্রুতা ছিল জমি নিয়ে গোলমালের জেরে। ঘটনার দিন দুষ্কৃতীরা যে গাড়িতে এসেছিল তার ব্যবস্থা নন্দই করে দেয়। জেলা পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, পুরনো ওই গাড়ি কিনতে শঙ্কররা ৯৬ হাজার টাকা দিয়েছিল নন্দকে। শ্রীনু ও তার শাগরেদরা গুলিতে জখম হওয়ার পরে মেদিনীপুর মেডিক্যালেও এসেছিল নন্দ, ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ কিনা দেখতে। তারপর ঝাড়গ্রামের গজাশিমূলে গিয়ে এক পরিচিতের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গজাশিমূল থেকে তাকে ধরে পুলিশ।

খড়্গপুরের বাসিন্দা রাজেশ সাউকে রেলশহর থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, খড়্গপুরের নার্সিংহোমে কাজ করার সময় বরুণের সঙ্গে হামলাকারী দলের একজনের পরিচয় হয়েছিল। সেই সূত্রেই গুলিতে ঘায়েল

দুষ্কৃতীকে ঘাটালে বরুণের বাড়িতে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করে শঙ্কর। রাজেশের হাত দিয়ে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েও দেয়। ভারতীদেবী জানান, বৃহস্পতিবার বাংলা-ওড়িশা সীমানা থেকে শঙ্করকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Srinu Naidu Armaments
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE