Advertisement
E-Paper

সবং কাণ্ডে ধৃতের হঠাৎ জেল বদল

সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার সাংবাদিক বৈঠকে চরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সবং-কাণ্ডে ফের প্রশ্নের মুখে জেলা পুলিশের ভূমিকা!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩১
মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে মানস ভুঁইয়া। - ফাইল চিত্র

মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে মানস ভুঁইয়া। - ফাইল চিত্র

সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার সাংবাদিক বৈঠকে চরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সবং-কাণ্ডে ফের প্রশ্নের মুখে জেলা পুলিশের ভূমিকা! ওই ঘটনায় ধৃত ছাত্র পরিষদ (সিপি) কর্মী অনুপম আদককে রবিবার দুপুরে হঠাৎ মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে হাওড়া সংশোধনাগারে সরানোর পরেই এই প্রশ্ন উঠেছে। মেদিনীপুরের কারা কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন, জেলা পুলিশের কথাতেই অনুপমের এই জেল-বদল।

সবং সজনীকান্ত কলেজে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানা খুনের ঘটনায় ধৃত ওই কলেজেরই তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অনুপম মেদিনীপুর আদালতে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, গোপন জবানবন্দি দেওয়ার সময় পুলিশের চাপের মুখে তিনি তাদের শেখানো কথাই বলতে বাধ্য হয়েছেন। সেই জবানবন্দি বাতিলের আর্জিও আদালতে জানিয়েছেন তিনি। কাল, মঙ্গলবার তা নিয়ে শুনানি রয়েছে মেদিনীপুর আদালতে। তার ঠিক আগেই কেন অনুপমকে আচমকা হাওড়া সংশোধনাগারে সরানো হল, সে প্রশ্ন এ দিন তুলেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।

জেলার একাধিক কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, মানসবাবু গত কালই দেখা করে অনুপম-সহ ধৃত ছাত্র পরিষদ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের উপর অত্যাচার নিয়ে সরবও হয়েছেন। সবং-এর ঘটনা নিয়ে আগাগোড়াই সক্রিয় মানসবাবু। ওই খুনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে তিনিই দিনের পর দিন ধর্না-অনশন চালিয়ে গিয়েছেন। জেলায় গিয়ে আন্দোলনও করছেন। এর ফলে ছাত্র পরিষদ কর্মীরা যেমন চাঙ্গা হচ্ছে, তেমনই চাপ বাড়ছে প্রশাসনের উপরে। ওই কংগ্রেস নেতাদের দাবি, এ কারণেই মানসবাবু দেখা করার পরেই আতঙ্কিত পুলিশ এখন চাপ দিয়ে অনুপমের অবস্থান বদলাতে চায়। মেদিনীপুর জেলে অনুপমের কাছে গিয়ে পুলিশ যে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করছে, এই অভিযোগ গত কালই করেছিলেন মানসবাবু। তাঁর অভিযোগ ছিল, জেলে গিয়েও পুলিশ অনুপমকে ভয় দেখাচ্ছে। কাগজে সই করে দিতে বলছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই হইচইও শুরু হয়েছে। তাই অনুপমকে হাওড়ায় পাঠিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে পুলিশ।

মানসবাবুও এ দিন বলেন, ‘‘জবানবন্দি প্রত্যাহার করতে চেয়ে অনুপম আবেদন জানানোর পর থেকেই পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। মেদিনীপুর পুলিশ হায়নার মতো আচরণ করছে! আমরা চেয়েছিলাম, মেদিনীপুর জেলে ওকে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হোক। কিন্তু, হাওড়ায় পাঠিয়ে দেওয়ায় ওর উপরে অত্যাচার বাড়বে। আমরা আতঙ্কিত।’’

অনুপমের হঠাৎ জেল বদল নিয়ে মেদিনীপুর সংশোধনাগারের সুপার স্বরূপ মণ্ডল শুধু বলেছেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওকে হাওড়ায় সরানো হয়েছে।” কারা দফতরের একটি সূত্রের খবর, এ ক্ষেত্রে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের ‘চাপ’ ছিল। এ দিন এডিজি (কারা) অধীর শর্মা বলেন, ‘‘জেলা পুলিশ আমাদের জানিয়েছিল, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব মেদিনীপুর সংশোধনাগারে গিয়ে অনুপমকে তাঁর জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য বোঝাচ্ছিলেন।

সে জন্যই এই সিদ্ধান্ত।’’ জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ অবশ্য এ প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি। সব শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নো কমেন্টস্‌।’’

এ দিন বিধায়ক মানসবাবু কারামন্ত্রী হায়দর আজিজ সফিকে ফোন করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মেদিনীপুর থেকে হাওড়া যাতায়াতের পথে অনুপমের উপর অত্যাচার যে বাড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী! মন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন, এক জেল থেকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। এখানে কারা দফতরের কিছু করার নেই। এর ফলে, মানসবাবুদের আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

বিধায়কের মতোই সবংয়ের দশগ্রামের বাসিন্দা, অনুপমের মা প্রতিমা আদকেরও আশঙ্কা, ছেলের উপরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়বে। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘ছেলের সঙ্গে দেখা করতে মেদিনীপুর জেলে তা-ও যেতাম। হাওড়ায় তো আর যাওয়া হবে না। আমাদের চোখের আড়ালে রেখে ওর উপরে আরও নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যে বলানোর চেষ্টা হবে বলেই আশঙ্কা করছি।’’ জেল বদলের বিষয়টি জানতেন না বলে দাবি করেছেন অনুপমের আইনজীবী হরিসাধন ভট্টাচার্যও। তাঁর বিস্ময়, “আমাকে না জানিয়েই আমার মক্কেলকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হল! ভাবা যায়?”

বিরোধীরা আবার তুলেছেন সাত্তোরের নির্যাতিতার প্রসঙ্গও। সাত্তোরের বিজেপি সমর্থক পরিবারের ওই বধূকেও মিথ্যা মামলায় বীরভূম জেলা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল বলে অভিযোগ। সিউড়ি সংশোধনাগারে তাঁর সঙ্গে বাম বিধায়কদেকর দেখা না করতে দেওয়ায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন। মমতারই হস্তক্ষেপে পরদিন বাম প্রতিনিধিরা সিউড়ি জেলে গিয়েওছিলেন। কিন্তু, সেখানেও ধৃতকে জেল থেকে অন্তত সরায়নি জেলা পুলিশ।

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে অনুপমের জেল-বদলে পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশের এত সক্রিয়তা কেন?

কংগ্রেস নেতৃত্বের যুক্তি, নিয়ম মাফিক জেলার বিধায়কই আগাম নোটিস দিয়ে সেই জেলার সংশোধনাগারে গিয়ে কোনও বিচারাধীন বন্দির সঙ্গে দেখা করতে পারেন। কিন্তু, অন্য জেলায় এই নিয়ম খাটে না। অনুপমকে হাওড়া জেলে পাঠিয়ে দেওয়ায় মানসবাবু আর তাঁর সঙ্গে সহজে দেখা করতে পারবেন না।

গত ৭ অগস্ট সবং কলেজে ওই খুনের ঘটনার পরে প্রথমে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর তিন জনকে গ্রেফতার করা হলেও ক্রমে মামলার পট পরিবর্তন হয়। একে একে গ্রেফতার হন অনুপম-সহ ছাত্র পরিষদের চার নেতা-কর্মী। কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি ভারতী ঘোষের নেতৃত্বাধীন জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়। তাদের অভিযোগ, ঘটনার পরেই যে হেতু খোদ মুখ্যমন্ত্রী এক দল ছাত্রের নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি এবং ছাত্র পরিষদের কোন্দলের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, তাই সেই তত্ত্বে মান্যতা দিতেই পুলিশ সুপার মামলা সাজাচ্ছেন। ধৃত সিপি কর্মীদের মধ্যে একমাত্র অনুপমই আদালতে গোপন জবানবন্দি দিয়েছিলেন।

আদালতে পুলিশের জমা দেওয়া চার্জশিটে দেখা যায়, অনুপম ছাড়া বাকি ধৃত তিন সিপি কর্মীর বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ আনে পুলিশ। অনুপমের বিরুদ্ধে রয়েছে মারধর-সহ কিছু জামিনযোগ্য ধারা। এর পরেই মেদিনীপুর আদালতে লিখিত ভাবে তাঁর গোপন জবানবন্দি বাতিলের আর্জি জানান। ওই আবেদনে অনুপমের অভিযোগ ছিল, ‘গত ১০ সেপ্টেম্বর জেল থেকে আদালতে আসার সময় বিশ্বজিত্‌ মণ্ডল (মামলার তদন্তকারী অফিসার) গাড়িতে আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি ভয় দেখিয়ে বলেন, তাঁর শেখানো কথা অনুযায়ী আদালতে জবানবন্দি না দিলে পুলিশ হেফাজতে নির্মম অত্যাচার করা হবে এবং পরিবারের চরম সর্বনাশ করা হবে।’

সবং-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে ইতিমধ্যে হাইকোর্টেও মামলা হয়েছে। সেই মামলার শুনানি রয়েছে আজ, সোমবার। মানসবাবু বলেন, ‘‘গোড়া থেকেই তো মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো মামলা সাজাচ্ছে পুলিশ। কখনও তদন্তকারী অফিসার বদলানো হচ্ছে, কখনও হুমকি দিয়ে জবানবন্দি আদায় করা হচ্ছে। সিবিআই ছাড়া সত্যি সামনে আসবে না।’’

sabang student murder anupam adak chhatra parisad sabang manas bhuniya jail shifting
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy