কবির লেখার ঘরে নাতনি মিউ ও বড় মেয়ে কৃষ্ণকলি (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
যদিও নিজের কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর রসিকতার অন্ত ছিল না। কখনও তিনি নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার মতো লোকেদের মা-সরস্বতী দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে মারেন।’ আবার লিখেছেন কোথাও, ‘আমার লেখায় আমি দেখেছি, যে জায়গাটা লোকে খুব প্রশংসা করেছে, এটা দারুণ লিখেছো, সে সব জায়গা, আমি দেখেছি, আসলে আমার নয়। অন্যের কথা। সাধারণ মানুষের কথা। আমি মেরে দিয়েছি। আত্মসাৎ করেছি। কেউ ভিক্ষে করে খায়। তুমি কী করো? না, টুকিয়ে, টুকিয়ে খাই।’ তবে দিনের শেষে নিজের কবিতা লেখার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি চাই কবিতা দিয়ে মানুষের হাতগুলোকে এমন ভাবে কাজে লাগাতে যাতে দুনিয়াটা মনের মতো করে আমরা বদলে নিতে পারি।’
আর এখন যখন ধর্ম ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, ধর্মের শাখাপ্রশাখায় যেখানে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চতুর্দিক, সেখানে সেই ১৯৮৫ সালে এক জায়গায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘এ দেশের মুসলমানের সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষের তো রক্তেরই সম্বন্ধ।’ লিখেছিলেন, ‘...মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে শাস্ত্রের গণ্ডি টেনে ধর্মকে যারা খাটো করতে চাইছে, আসলে তারাই যে ঘরের
শত্রু বিভীষণ— এটা আজ বোঝবার সময় এসেছে।’ বিশ্বাস করতেন, ইংরেজি আগ্রাসনেও ‘মুখে মুখে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে।’ বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন— ‘আমি যত দূরেই যাই।/ আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোনে/ সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা...’।
তাঁর সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই সম্পর্কের যাত্রাপথকে রাজ্য সরকারের তরফে আগামিকাল, মঙ্গলবার উদ্যাপন করা হবে। সেই সঙ্গে সারা শহর জুড়ে ‘পদাতিক’ কবির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অন্য অনেক অনুষ্ঠান তো রয়েছেই।
‘‘নিজের জন্মদিন পালন পছন্দ না করলে কী হবে, আমাদের জন্মদিন পালনের জন্য সব কিছু করতেন দাদু। হয়তো ঘর অন্ধকার। রাতে ঘুমিয়ে আছি। মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার সেই ঘরে ঢুকতেন। তার পরে বলতেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’’’— বলছিলেন পৃথা।
আসলে শুধু নাতনিদের অন্ধকার ঘরেই নয়, তাঁর অনুজ কবিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে স্বীকার করেছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমৃত্যু লেখার আলো নিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছেন। তার পরে সেই লেখার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন চার দিকে। আর সেই আলোয় সরে গিয়েছে চাপ-চাপ অন্ধকার। কিন্তু তিনি, সেই সমস্ত আলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও নির্মোহ ভাবে শুধু বলেছেন,— ‘আমাকে কেউ কবি বলুক/ আমি চাই না।/ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে/ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত/ যেন আমি হেঁটে যাই।’