Advertisement
E-Paper

‘আমাকে কেউ কবি বলুক, আমি চাই না’

৫বি, শরৎ ব্যানার্জি রোডের ছোট ঘরের জানলাগুলো এখন সব সময় বন্ধই থাকে। খোলা হয় না। ঘরের এক দিকে বইয়ের র‌্যাকে সার দিয়ে বই। পুরনো, ধুলোপড়া। পৃথা রায় বলছিলেন, ‘‘দাদু তো চার দিকে বই ছড়িয়ে বসতেন। ঘরে বসার জায়গাটুকুও থাকত না।’’

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৩
স্মরণে: লেখায় মগ্ন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আর্কাইভ থেকে।

স্মরণে: লেখায় মগ্ন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আর্কাইভ থেকে।

লেখায় ডুবে আছেন। বাড়ির লোকজন মনে করলেন, বাইরের আওয়াজে হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। বন্ধ করতে যাবেন দরজা-জানলা। কিন্তু তিনি নারাজ। রাস্তায় মানুষ যাতায়াত করছে। মানুষকে দেখতে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যে অসম্ভব ভালবাসতেন! তাই জানলা বন্ধ করা যাবে না! জানলার পাশে বসেই লিখতেন।

৫বি, শরৎ ব্যানার্জি রোডের ছোট ঘরের জানলাগুলো এখন সব সময় বন্ধই থাকে। খোলা হয় না। ঘরের এক দিকে বইয়ের র‌্যাকে সার দিয়ে বই। পুরনো, ধুলোপড়া। পৃথা রায় বলছিলেন, ‘‘দাদু তো চার দিকে বই ছড়িয়ে বসতেন। ঘরে বসার জায়গাটুকুও থাকত না।’’ পৃথা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বড় নাতনি। পৃথার ডাকনাম মিউ। তাঁর জন্যই সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘মিউ-এর জন্য ছড়ানো ছিটানো’। পৃথা ওরফে মিউ আরও বলছিলেন, ‘‘দাদুর শতবর্ষের জন্য অন্য অনেক কিছুই পাল্টেছি বাড়ির। কিন্তু এই র‌্যাক থেকেই উনি বই নামিয়ে নিতেন খুশি মতো। তাই আমরা এই জায়গাটা পাল্টাইনি।’’

ফলে শততম জন্মদিনের সামনে দাঁড়িয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখার ঘরের চেহারা মোটামুটি একই রয়েছে। কবি, কবিপত্নীর বিভিন্ন সময়ের ছবি দেওয়াল জুড়ে, তাঁর সংগৃহীত বই, সেই সঙ্গে সারাটা ঘরের আটপৌরে চেহারা— সব একই রয়েছে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে (মাঝে)। ছবি: আর্কাইভ থেকে।

কবির বড় মেয়ে কৃষ্ণকলি (পুপে) রায় বলছিলেন, হাঁটতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। হাঁটতে-হাঁটতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আড্ডা মারতে, কথা বলাটাও ভীষণ পছন্দ ছিল তাঁর। আবার হয়তো বাজারে গিয়েছেন। খেয়াল করতেন, কে ফাঁকা বসে রয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই সব জিনিস কিনে নিয়ে আসতেন। কৃষ্ণকলির কথায়, ‘‘নিয়মিত পচা মাছ আনতেন। তা নিয়ে মা-র সঙ্গে ঝামেলাও হত। বাবা শুধু বলতেন, ওঁর (যাঁর কাছ থেকে মাছ কিনেছেন) বউনি হচ্ছিল না। তাই এনেছি। না হলে ওঁদের চলবে কী করে।’’ মানুষের সঙ্গে এই সহজ সম্পর্ক ঘুরে-ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়, কবিতায়। সক্রিয় বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পার্টি করেছেন দীর্ঘ বছর। জেলও খেটেছেন।

কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাধারণ মানুষের কথাকে নিজের কবিতায় তুলে এনেছিলেন। সাধারণ মানুষের ভাষাই তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল কবিতা। শুধু কবিতাই নয়। অসাধারণ গদ্য লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন!’’

কবির লেখার ঘরে নাতনি মিউ ও বড় মেয়ে কৃষ্ণকলি (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।

যদিও নিজের কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর রসিকতার অন্ত ছিল না। কখনও তিনি নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার মতো লোকেদের মা-সরস্বতী দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে মারেন।’ আবার লিখেছেন কোথাও, ‘আমার লেখায় আমি দেখেছি, যে জায়গাটা লোকে খুব প্রশংসা করেছে, এটা দারুণ লিখেছো, সে সব জায়গা, আমি দেখেছি, আসলে আমার নয়। অন্যের কথা। সাধারণ মানুষের কথা। আমি মেরে দিয়েছি। আত্মসাৎ করেছি। কেউ ভিক্ষে করে খায়। তুমি কী করো? না, টুকিয়ে, টুকিয়ে খাই।’ তবে দিনের শেষে নিজের কবিতা লেখার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি চাই কবিতা দিয়ে মানুষের হাতগুলোকে এমন ভাবে কাজে লাগাতে যাতে দুনিয়াটা মনের মতো করে আমরা বদলে নিতে পারি।’

আর এখন যখন ধর্ম ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, ধর্মের শাখাপ্রশাখায় যেখানে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চতুর্দিক, সেখানে সেই ১৯৮৫ সালে এক জায়গায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘এ দেশের মুসলমানের সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষের তো রক্তেরই সম্বন্ধ।’ লিখেছিলেন, ‘...মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে শাস্ত্রের গণ্ডি টেনে ধর্মকে যারা খাটো করতে চাইছে, আসলে তারাই যে ঘরের

শত্রু বিভীষণ— এটা আজ বোঝবার সময় এসেছে।’ বিশ্বাস করতেন, ইংরেজি আগ্রাসনেও ‘মুখে মুখে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে।’ বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন— ‘আমি যত দূরেই যাই।/ আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোনে/ সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা...’।

তাঁর সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই সম্পর্কের যাত্রাপথকে রাজ্য সরকারের তরফে আগামিকাল, মঙ্গলবার উদ্‌যাপন করা হবে। সেই সঙ্গে সারা শহর জুড়ে ‘পদাতিক’ কবির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অন্য অনেক অনুষ্ঠান তো রয়েছেই।

‘‘নিজের জন্মদিন পালন পছন্দ না করলে কী হবে, আমাদের জন্মদিন পালনের জন্য সব কিছু করতেন দাদু। হয়তো ঘর অন্ধকার। রাতে ঘুমিয়ে আছি। মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার সেই ঘরে ঢুকতেন। তার পরে বলতেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’’’— বলছিলেন পৃথা।

আসলে শুধু নাতনিদের অন্ধকার ঘরেই নয়, তাঁর অনুজ কবিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে স্বীকার করেছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমৃত্যু লেখার আলো নিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছেন। তার পরে সেই লেখার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন চার দিকে। আর সেই আলোয় সরে গিয়েছে চাপ-চাপ অন্ধকার। কিন্তু তিনি, সেই সমস্ত আলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও নির্মোহ ভাবে শুধু বলেছেন,— ‘আমাকে কেউ কবি বলুক/ আমি চাই না।/ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে/ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত/ যেন আমি হেঁটে যাই।’

Poet Subhash Mukhopadhyay সুভাষ মুখোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy