Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সস্ত্রীক খুন কনস্টেবল, কারণ নিয়ে ধন্দ কাটছে না পুলিশের

বাড়ির তেতলায় ঘুমিয়েছিল ছেলে। দোতলায় দু’টি ঘরে বাবা-মা। সিঁড়ির জানলার গ্রিল খুলে দোতলায় উঠে দুষ্কৃতীরা ওই দম্পতিকে বেঁধে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, ঘর দু’টি তছনছ করে চলে গেল। অথচ, টের পায়নি ছেলে বা পড়শিরা! মঙ্গলবার গভীর রাতে কৃষ্ণনগরের পালপাড়ায় ওই হামলার পরে, শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি পুলিশ কনস্টেবল রমাপ্রসাদ চন্দ (৫২) ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী চন্দকে (৫০)। কৃষ্ণনগরের এই জোড়া খুন ধন্ধে ফেলেছে পুলিশকে।

রমাপ্রসাদবাবুর স্ত্রী জয়ন্তীদেবী (বাঁ দিকে)। নিহত রমাপ্রসাদ চন্দ। —নিজস্ব চিত্র।

রমাপ্রসাদবাবুর স্ত্রী জয়ন্তীদেবী (বাঁ দিকে)। নিহত রমাপ্রসাদ চন্দ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৫ ০২:৩৫
Share: Save:

বাড়ির তেতলায় ঘুমিয়েছিল ছেলে। দোতলায় দু’টি ঘরে বাবা-মা। সিঁড়ির জানলার গ্রিল খুলে দোতলায় উঠে দুষ্কৃতীরা ওই দম্পতিকে বেঁধে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, ঘর দু’টি তছনছ করে চলে গেল। অথচ, টের পায়নি ছেলে বা পড়শিরা! মঙ্গলবার গভীর রাতে কৃষ্ণনগরের পালপাড়ায় ওই হামলার পরে, শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি পুলিশ কনস্টেবল রমাপ্রসাদ চন্দ (৫২) ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী চন্দকে (৫০)। কৃষ্ণনগরের এই জোড়া খুন ধন্ধে ফেলেছে পুলিশকে।

নদিয়ার পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বুধবার বলেন, ‘‘তদন্ত আরও না এগোলে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে খুনের কারণ বলা সম্ভব নয়।’’

রমাপ্রসাদবাবু প্রায় ন’বছর জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মাস দু’য়েক আগে জেলা পুলিশের ‘স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ’(এসওজি)-এ বদলি হন। জয়ন্তীদেবী গৃহবধূ। ছেলে রুদ্রাশিস স্থানীয় স্কুলে দশম শ্রেণির পড়ুয়া। পুলিশকে রুদ্রাশিস জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে দোতলায় দু’টি আলাদা ঘরে ঘুমিয়েছিলেন রমাপ্রসাদবাবু ও জয়ন্তীদেবী। তিন তলার ঘরে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে শুয়ে পড়ে। এ দিন ভোর ৫টা নাগাদ জয়ন্তীদেবী তাঁকে মোবাইলে ফোন করে বলেন, ‘‘বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তুই ঠিক আছিস তো!’’

রুদ্রাশিসের দাবি, ‘‘বেরোতে গিয়ে দেখি, আমার ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। মা-কে বলি ‘দরজা খুলে দাও’। তখন মা বলেন, ‘আমি দরজা খোলার মতো অবস্থায় নেই’! দরজা ভেঙে দোতলায় গিয়ে দেখি, বাবা আর মা রক্তে মাখামাখি অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। বাবার হাত-পা বাঁধা। ঘরগুলো লন্ডভন্ড।’’

ঘটনাস্থলে গিয়েও এ দিন দেখা গিয়েছে, দু’টি ঘরেই বিস্তর রক্তের দাগ। একটি ঘরের বক্সখাটের গা বেয়ে গড়িয়েছে রক্ত। তোষকেও রক্তের ছোপ। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার, জামাকাপড় মেঝেয় ইতস্তত ছড়ানো। অন্য ঘরের বিছানার ধারে তখনও মশারি ঝুলছে। সে ঘরের মেঝেরও একই চেহারা। একটি ঘর থেকে এক জোড়া হাওয়াই চটি এবং একটি টুপি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পরে একটি ছোট মাঠ পেরোলেই রমাপ্রসাদবাবুদের বিশাল বাড়ি। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকেছিল দুষ্কৃতীরা। একতলা আর দোতলার মাঝের ল্যান্ডিংয়ের জানলার গ্রিলের স্ক্রু খুলে দোতলায় উঠেছিল। কিন্তু সেই স্ক্রু খুলতে যথেষ্ট সময় লাগার কথা। শব্দও হওয়ার কথা। বাড়ির বাসিন্দাদের কেউ ব্যাপারটা টের পেলেন না কেন, বুঝতে পারছেন না তদন্তকারীরা।

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের মনে হয়েছিল, ডাকাতেরা এই হামলা করেছে। কিন্তু একটি ঘরের আলমারি থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ এবং একটি ব্লেজারের পকেটে প্রায় ৫৬ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছে। হামলাকারীরা তা নিয়ে যায়নি। ফলে, অন্য সম্ভাবনার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে পুলিশ। ডিআইজি (মুর্শিদাবাদ রেঞ্জ) কল্লোল গনাই, আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) অজেয় রানাডে ও আইজি (সিআইডি) সঞ্জয় সিংহ এ দিন ঘটনাস্থলে যান। গিয়েছিলেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও। প্রশিক্ষিত কুকুরও ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে লাভ হয়নি।

পুলিশ সূত্রের খবর, পুলিশের চাকরির পাশাপাশি বড় আকারে সুদের কারবার করতেন রমাপ্রসাদ। তাঁর ঘর থেকে বিভিন্ন লোকের নামে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট এবং তাহেরপুর, ভাতজাংলা এলাকার বেশ কয়েকজনের নামে গোটা সাতেক জমি-বাড়ির দলিল পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত সেগুলি বন্ধক রেখে রমাপ্রসাদবাবু সুদে টাকা
ধার দিয়েছিলেন। আর এই সুদের ব্যবসার যাবতীয় তথ্যই জানতেন জয়ন্তীদেবী। রমাপ্রসাদবাবু ছিলেন জয়ন্তীদেবীর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী।

কিন্তু খুন করাই যদি মতলব হতো, তা হলে দু’জনকে বেঁধে রেখে ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করা হল কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘আততায়ীরা হয়তো এমন কিছুর খোঁজে এসেছিল, যেটা রমাপ্রসাদবাবুর কাছে ছিল। তাই ঘরগুলো তছনছ করে সেটা খুঁজেছে।’’

তবে আততায়ীরা যে কীসের খোঁজে এসেছিল সে সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই। পুলিশকে এমনটাই জানিয়েছে রুদ্রাশিস। তাকে বার বারই বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘বাবা মাঝেমধ্যেই বলতেন, ওই সিঁড়ির জানলাটা একদম সেফ (নিরাপদ) নয়, কোনও দিন অঘটন হলে ওটা দিয়েই কেউ ঢুকবে। সে কথাটাই সত্যি হয়ে গেল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Krishnanagr Bandits police Nadia SOG CID
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE