Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গ্রাহকই ভরসা ব্যাঙ্কের, টাকা নেই, দায় নেই সুরক্ষারও!

কখনও খরচ, কখনও লোকাভাব— হরেক কারণ তুলে ধরছেন তাঁরা। ভরসা রাখছেন শুধু গ্রাহক সচেতনতায়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০৪:২৭
Share: Save:

দায় সারা।

এটিএম থেকে টাকা লোপাট নিয়ে শহর তোলপাড়। কষ্টে জমানো টাকা ব্যাঙ্কের সিন্দুকে কতখানি নিরাপদ, সেই চিন্তায় ঘুম ওড়ার জোগাড় আমজনতার। কিন্তু তার মধ্যেও সেই সুরক্ষায় দায় কার্যত নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলছে ব্যাঙ্কগুলি। প্রত্যেক এটিএমে রক্ষী মোতায়েন থেকে শুরু করে নিয়মিত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা— কোনও কিছুই তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় কবুল করছেন ব্যাঙ্ক-কর্তারা। বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। তার জন্য কখনও খরচ, কখনও লোকাভাব— হরেক কারণ তুলে ধরছেন তাঁরা। ভরসা রাখছেন শুধু গ্রাহক সচেতনতায়।

ব্যাঙ্কের এই ‘বয়ানে’ ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। অভিযোগ, জিএসটির দৌলতে ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় কর বেড়েছে। লাফিয়ে বেড়েছে পরিষেবার চার্জ, ন্যূনতম ব্যালান্স এবং তা না রাখার জরিমানাও। তা হলে এখন টাকার সুরক্ষা দেওয়ার বেলায় কেন হাত উল্টে দেবে ব্যাঙ্ক? অনেকের প্রশ্ন, কার্ডে লেনদেনই যদি এমন অরক্ষিত হয়, তা হলে তো কেন্দ্রের ডিজিটাল-প্রচার পুরোটাই ফাঁপা!

কলকাতায় এটিএম জালিয়াতি কিংবা দেশের অন্যান্য প্রান্তেও টাকা তোলার পরে গ্রাহকের উপরে হামলা— রক্ষীহীন এটিএম যে রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের মতোই ভয়ঙ্কর, তা দেখা গিয়েছে বার বার। কিন্তু তার পরেও এত এটিএম রক্ষীহীন কেন? এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘খরচে পোষাবে কী করে বলতে পারেন?’’

ব্যাঙ্কের ব্যাখ্যা

• অধিকাংশ এটিএমে রক্ষী নেই। সম্ভব নয় তা মোতায়েনও।

• সিসি ক্যামেরা আছে। কিন্তু লোক নেই তা নিয়মিত দেখার।

• কার্ড নকল রুখতে এটিএমে নতুন যন্ত্র বসছে। কিন্তু তাতেও জালিয়াতি রোখা শক্ত।

• টাকা লোপাটের যত ঘটনা ঘটেছে, হয়তো তার থেকে অনেক বেশি কার্ডের তথ্য মজুত দুষ্কৃতীদের কাছে। তাই বরং দ্রুত পিন পাল্টে ফেলুন গ্রাহকেরা।

তা হলে প্রশ্ন

• নিরাপত্তা দেওয়া অসম্ভব বলে কি মেনেই নিচ্ছে ব্যাঙ্ক? ভরসা শুধু গ্রাহক সচেতনতা!

• ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে প্রচারের ঢাক বাজছে নাগাড়ে। তার সুরক্ষার এই তবে হাল?

• বাড়িতে অসুস্থতা কিংবা বিয়ের মতো অনুষ্ঠানের জন্য সেভিংস অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা থাকলে কি তবে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই?

• এটিএম অরক্ষিত। হ্যাকার ত্রাসে নেট ব্যাঙ্কিং। এর পরেও কোন ভরসায় শাখায় আসা কমানোর কথা বলে ব্যাঙ্ক?

• খরচের যুক্তিতে নিখরচার এটিএম লেনদেন কমেছে। বেড়েছে ন্যূনতম ব্যালান্স। পরিষেবার চার্জ। এমনকি করও। তা হলে সুরক্ষা?

খরচের যুক্তিতে নাকচ হয়ে যাচ্ছে এটিএমের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়মিত খতিয়ে দেখার দাবিও। দোসর লোকাভাব। এখানেও প্রশ্ন শেষের আগেই ধেয়ে আসছে পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘অত লোক কোথায়?’’

কিন্তু কলকাতার ঘটনাই তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, একটু আগে থেকে ফুটেজে নজর রাখলে জালিয়াতদের হয়তো আগেই পাকড়াও করা যেত। অন্তত এত নিশ্চিন্তে এটিএমে কার্ড নকলের যন্ত্র (স্কিমার) লাগাতে পারত না তারা। তা হলে? প্রসঙ্গ তুলতেই ইউকো ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার আর কে চাট্টানি বলেন, ‘‘দেশে মোট এটিএম প্রায় দু’লক্ষ। এত এটিএমের ফুটেজ নিয়মিত দেখতে গেলে তো এটিএম পরিষেবাই অলাভজনক হয়ে যাবে।’’ আর এক ব্যাঙ্ক-কর্তা মানছেন, চুরি-ডাকাতি হলে পরে দেখা— ক্যামেরার ব্যবহার এখনও সীমাবদ্ধ সেখানেই।

সম্প্রতি এটিএমের নিরাপত্তা আটোসাঁটো করতে ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্যতামূলক ভাবে কিছু পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে দেশের সমস্ত এটিএমে ‘অ্যান্টি স্কিমিং’ যন্ত্র বসাতে হবে। যাতে সেখানে কার্ডের নকল করা আটকানো যায়। রয়েছে এটিএমে নতুন সফটওয়্যার লাগানোর নির্দেশও। কিন্তু ‘অসহায়’ ব্যাঙ্ক-কর্তারা নিজেরাই বলছেন, নতুন রক্ষাকবচ ভেদের উপায় বার করতেও বেশি সময় লাগবে না জালিয়াতদের!

দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে কলকাতায় সদর দফতর থাকা এক ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার (তথ্যপ্রযুক্তি) বলছেন, ‘‘এটিএম থেকে টাকা লোপাটের যত ঘটনা ঘটেছে, আমার আশঙ্কা, তার থেকে অনেক বেশি এটিএম কার্ডের তথ্য রয়েছে দুষ্কৃতীদের হাতে। তাই গ্রাহকদের উচিত অবিলম্বে পিন নম্বর বদলানো। মাঝেমধ্যেই এটা
করা জরুরি।’’

স্টেট ব্যাঙ্কের এক কর্তা বলছেন, ‘‘জালিয়াতিতে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা খোয়া গেলে ব্যাঙ্ক সেই ক্ষতি মিটিয়ে দেয়। গ্রাহকদের দুশ্চিন্তা কোথায়?’’ শুনে এক গ্রাহকের জিজ্ঞাসা, ‘‘তা হলে কখন টাকা চুরি যায়, আর কী ভাবে ফেরত পাব— এই চিন্তায় রাত জাগাই আমাদের কাজ, তাই তো?’’

চাট্টানি বলছিলেন, ‘‘এটিএম কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, তার তালিকা দেওয়া সত্ত্বেও বহু গ্রাহকই তা মানেন না।’’

সাবধানের মার নেই, হক কথা। সতর্ক যে হওয়া উচিত, সন্দেহ নেই তাতেও। কিন্তু তা বলে কি এ ভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারে ব্যাঙ্ক?

এটিই প্রশ্ন ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bank Fraud ATM fraud
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE