কালো কাচ দিয়ে ঘেরা দোতলার বারান্দা। নীচেই লেখা বাড়ির নাম—‘অপরাজিতা’। ওই বাড়ির কর্তা, পেশায় চিকিৎসক তপনকুমার জানাকেই ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কয়েক পা দূরে আফতাব অ্যাভিনিউয়ের উপরে তিনতলা বাড়ি। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান তপনকুমার জানার সঙ্গে থাকেন তাঁর স্ত্রী, আরামবাগ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক সুস্মিতা জানা। আর রয়েছেন সুস্মিতার অসুস্থ মা। ওই চিকিৎসক-দম্পতির একমাত্র সন্তান বিদেশে থাকেন।
শনিবার রাতে সিবিআই ও বর্ধমান থানার চারটে গাড়ি ওই বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। পুলিশকে বাইরে রেখে সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা ভিতরে ঢুকে যান। কৌতুহলী প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি শুরু হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিতে শুরু করেন বর্ধমান মেডিক্যালের চিকিৎসকেরাও। রবিবার দুপুরের পরে সিবিআই জানায়, জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের (এনএমসি) মূল্যায়নকারী হিসাবে কর্নাটকের বেলগাভিতে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তপন। ওই কলেজের অনূকূল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য তিনি ১০ লক্ষ টাকা চান বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে সিবিআই ফাঁদ পাততেই শনিবার তাতে আটকে পড়েন তিনি। গ্রেফতারের পরে বর্ধমান-সহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়।
বর্ধমান মেডিক্যালের অ্যানাটমি বিভাগের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের দাবি, তপন ২০১০ পর্যন্ত বর্ধমানেই ছিলেন। তার পরে মেদিনীপুর যান। সেখান থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। শেষ কয়েক বছর পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কাজ করছেন। এনএমসি পরিদর্শক হিসাবে মূল্যায়ণ করার জন্য তাঁর নানা রকম দাবিদাওয়ার কথা তাঁদের কানেও এসেছিল বলে জানান তিনি। উত্তরবঙ্গের এক চিকিৎসকের দাবি, “২০১৭-১৮ সাল থেকেই তপন এনএমসির সঙ্গে যুক্ত। সেই সময় পরিদর্শক দলে ছিলেন। পরে মূল্যায়নকারী হন। তপনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগও জমা পড়েছিল। সেই কারণেই নজরে ছিলেন।’’
যদিও তাঁর স্ত্রী একেবারেই মুখ খোলেননি। শুধু বলেন, “ সিবিআই ওয়ারেন্ট নিয়ে এসে রাতভর তল্লাশি চালিয়েছে। ওর সঙ্গে (তপন) আমার যোগাযোগ হয়নি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’’ বাড়ির ভিতরে দেখা যায়, ঘরের ভিতর একাধিক আলমারিতে থাকা নথিপত্র ঘেঁটে দেখার চিহ্ন স্পষ্ট। একাধিক নথি ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে। পরিচারিকার দাবি, “দরজা খুলতে বললে আমরা খুলে দিই। ওঁরা ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজা খোলে ভোর ৫টার পরে।’’
প্রতিবেশীরা জানান, পাশাপাশি বাড়ি হলেও ওই চিকিৎসক-দম্পতি কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন না। ১৫-১৬ বছর আগে পুরনো বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। তার আগে আফতাব অ্যাভিনিউয়ের একটি গলিতে থাকতেন। সেই বাড়ি বিক্রি করে দেন। পুরনো পাড়ার এক মহিলা বলেন, “আমাদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগই ছিল ওই চিকিৎসকের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করায় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। আমরাও আর যেচে কথা বলি না।” বাড়ির সামনে সেলুন, মুদিখানা, মশলার দোকান রয়েছে। তাঁদের দাবি, “গত ১৫ বছরে চিকিৎসকের সঙ্গে কারও ১৫ সেকেন্ড কথা হয়েছে, এমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। বিশেষ সুবিধার ছিলেন না।” পাড়ার কেউ অসুস্থ হলে ডাকলেও ওঁদের সাড়া পাওয়া যেত না বলে জানান প্রতিবেশী মহিলারা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)