Advertisement
E-Paper

‘দিদি’কে বাঁচাতে চন্দ্রবোড়ার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল চিকু, কামড়ও খেল! চলল জীবন-মরণ লড়াই

চিকুকে ওই অবস্থায় দেখে সময় নষ্ট করেননি বাড়ির কর্তা রামতুন। ‘মেয়ে’কে নিয়ে বৃষ্টি মাথায় করেই বাইকে চাপিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে যান তিনি। তার পরে ১৫ দিন ধরে হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চিকু।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০২
Dog saved life of child in Purba Bardhaman

চন্দ্রবোড়ার কামড়। চিকিৎসকের তৎপরতায় প্রাণ বাঁচল চিকুর। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

বাইরে তখন তেড়ে বৃষ্টি পড়ছে। সেই সঙ্গে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। ঘরে তখন অসুস্থ চিকু! বাড়ির ‘মেয়ে’। তার পায়ে সাপের কামড়ের দাগ। নেতিয়ে পড়েছে। অবস্থা দেখে আর দেরি করেননি পূর্ব বর্ধমানের গলসির বাসিন্দা রামতুন আর তাঁর স্ত্রী ইতু। বাইকে চাপিয়ে সোজা নিয়ে যান বর্ধমানের ঘোড়দৌড়চটির হাসপাতালে। সেখানে দিন কয়েক জীবন-মরণ লড়াই করার পর আপাতত সুস্থ সে!

‘দিদি’র সঙ্গে প্রায়ই খুনসুটি লেগেই থাকে চিকুর। তবে দুই ‘বোনে’র মধ্যে ভালবাসাও প্রচুর। কেউ কাউকে ছেড়ে এক দিনও থাকতে পারে না। তাই ‘দিদি’কে বাঁচাতে চন্দ্রবোড়ার মতো বিষাক্ত সাপের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেই দু’দণ্ড ভাবেনি বছর ছয়েকের চিকু। রেহাই পায়নি সাপের কবল থেকে। তার পায়ে কামড় দেয় চন্দ্রবোড়া। সঙ্গে সঙ্গে নেতিয়ে পড়ে সে। পা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তার এই অবস্থা দেখে চিৎকার শুরু করে বাড়ি ছোট্ট মেয়েটি। সেই সময়ে পালিয়ে যায় চন্দ্রবোড়া। ছুটে আসেন বাবা-মা এবং বাড়ির অন্যেরা।

চিকুকে ওই অবস্থায় দেখে সময় নষ্ট করেননি বাড়ির কর্তা রামতুন। ‘মেয়ে’কে নিয়ে বৃষ্টি মাথায় করেই বাইকে চাপিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালে যান তিনি। তার পরে ১৫ দিন ধরে হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চিকু। দিন যত গড়াতে থাকে, দুশ্চিন্তা তত বাড়তে থাকে রামতুনদের। উদ্বিগ্ন মুখে সকলে হাসপাতালে অপেক্ষা করেন। চিকিৎসকদের কাছে বার বার চিকুর খবর নেন। দিন কয়েক পরে চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করে চিকু। তার পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে!

চিকু মানব সন্তান নয়। সে স্পিৎজ় প্রজাতির কুকুর। গায়ে ধবধবে সাদা লোম। কান দুটো সব সময় খাঁড়া হয়ে রয়েছে। চোখেমুখে এক অদ্ভুত শান্ত। কিন্তু আদৌ সে শান্ত নয়। রামতুনের কথায়, ‘‘চিকু সব সময় বাড়ি মাতিয়ে রাখে। আমার মেয়ের সঙ্গে খেলছে, খুনসুটি করছে। আমাদের সকলেরই ন্যাওটা। তবে খুবই সজাগ। বেচাল দেখলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলত।’’ সকলেই মানছেন, চিকুর সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে অজানা কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারতেন না!

সুস্থ হয়ে বাড়ি স্বমেজাজে চিকু।

সুস্থ হয়ে বাড়ি স্বমেজাজে চিকু। —নিজস্ব চিত্র।

সেই চিকুকে চন্দ্রবোড়া কামড়ে দেওয়ায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন রামতুন। কী করবেন, কী ভাবে বাঁচাবেন— সেই চিন্তাতেই মাথা খারাপ হয়ে যায়। তবে বেশি সময় নষ্ট করেননি। বাইক বার করে চিকুকে নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি। ঘটনার সময়ের কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে ওঠে রামতুনের কণ্ঠ, ‘‘আমার বড় মেয়ে ফ্রিজ থেকে দুধ আনতে গিয়েছিল। বুঝতে পারেনি ঘরের কোণে ওঁত পেতে রয়েছে চন্দ্রবোড়া। মেয়েকে দেখেই তাকে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মাঝে চলে আসে চিকু।’’ তার পরেই তিনি বলেন, ‘‘এই বিপদ আমার বড় মেয়ের হতে পারত। কিন্তু চিকু বাঁচিয়ে দিল।’’

চন্দ্রবোড়ার কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘মেয়ে’র পা দুটো নীল হয়ে গিয়েছিল, জানান চিকুর ‘মা’ ইতু। শুধু তা-ই নয়, রক্তবমিও শুরু হয়। বর্ধমানের পশু হাসপাতালে চিকুর চিকিৎসা চলে। ওই হাসপাতালের প্রাণী চিকিৎসক পার্থ সরকারের কয়েক দিনের চেষ্টায় প্রাণ বেঁচে যায় চিকুর। এখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। আবার পুরনো ‘ফর্মে’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ি। কুকুরকে সাপে কামড়ানোর চিকিৎসার অভিজ্ঞতা রয়েছে পার্থের। তাই চিকুকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর আর সময় নষ্ট করেননি তিনি। কী ভাবে চিকিৎসা করবেন তৎক্ষণাৎ মাথাতেই ছকে ফেলেন পরিকল্পনা। তার পরে সেই মতো চিকিৎসা শুরু করেন তিনি।

কী ভাবে প্রাণ ফিরে পেল চিকু?

পার্থ জানান, প্রথমেই ওই কুকুরের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ধরা পড়ে বিষের অস্তিত্ব। ওর শরীরে ‘হেমোটক্সিক’ বিষক্রিয়া শুরু হয়। শুধু তা-ই নয়, শরীরে ‘ক্লিনিক্যাল’ লক্ষণও প্রকট হতে থাকে। অর্থাৎ, কামড়ানোর জায়গা ক্রমশ ফুলে ওঠে, কালচে হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ব্যথা। রক্তবমিও শুরু হয় চিকুর। প্রথমেই তাকে ‘অ্যান্টিস্নেক ভেনম’ দেওয়া হয়। পার্থের মতে, এই সব রোগীর ক্ষেত্রে সাপোর্টিভ কেয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা চলাকালীন চিকুকে অ্যান্টিবায়োটিক, আই ফ্লুয়িড, পিপিআই ড্রাগ দিতে হয়। প্রয়োজনে ব্যথানাশক ও স্টেরয়েডও প্রয়োগ করা হয়েছে। বার বার কিডনি পরীক্ষা করা হয় তার। সব সময় তাকে পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা করা হয় চিকুর। তাতেই সুস্থ হয়ে ওঠে সে।

চিকিৎসকদের মতে, বর্ষাকাল এলেই বিশেষত গ্রামগঞ্জে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। বৃষ্টিতে গর্ত জলে ভরে আশ্রয়হারা হয়ে পড়ে সাপেরা। তখনই গর্ত থেকে বেরিয়ে নতুন আস্তানার খোঁজ শুরু করে। ঢুকে পড়ে ঘরে। আবার কখনও কখনও গবাদি পশুদের আস্তানাতেও আশ্রয় নেয়। ঘরোয়া পোষা প্রাণী— বিশেষ করে কুকুর ও বিড়াল সাপের দংশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বর্ষাকালে বাংলায় সাধারণত দু’ধরনের সাপের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। তবে কিছু সাপের বিষ থাকে না। কিছু আবার খুবই বিষধর। সেই তালিকায় রয়েছে চন্দ্রবোড়া বা বোড়া (রাসেল ভাইপার)। সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই সাপের বিষ। তবে চন্দ্রবোড়ার কোনও ফণা নেই। চিকিৎসক সরকারের কথায়, ‘‘চন্দ্রবোড়ার অ্যান্টিভেনাম পাওয়া সহজ নয়। আরও কঠিন চন্দ্রবোড়ার কামড়ের আফটার শক। ধীরে ধীরে মৃত্যু ডেকে আনে।’’ যদিও চিকিৎসার পর নতুন ‘জন্ম’ পেল চিকু।

Russell Viper snake bite Dog Purba Bardhaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy