Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্টেশনে ক্ষোভ, নার্সিংহোমে আর্জি

নিজস্ব প্রতিবেদন: মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বাতিল হয়ে গিয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। তার ঘণ্টা চারেক আগে এই ঘোষণা শুনেই হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল নানা এটিএমে। বুধবার বাজার-দোকানে সমস্যায় পড়তে হবে, আশঙ্কা করেছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই আশঙ্কা অনেকটা সত্যি হল। দিনভর নানা জায়গায় দেখা গেল তেমনই ছবি।সকাল পৌনে ১১টা নাগাদ আসানসোলের একটি নার্সিংহোমে মাকে ডায়ালিসিস করাতে নিয়ে এসেছিলেন মনি অহলুওয়ালিয়া। কাউন্টারে টাকা জমা দিতে গেলে কর্মী জানালেন পাঁচশো বা হাজারের নোট নেওয়া হবে না। অথচ মনিদেবীর কাছে শুধু পাঁচশোর নোট।

খুচরো দিতে নাজেহাল পেট্রোল পাম্পের কর্মী।

খুচরো দিতে নাজেহাল পেট্রোল পাম্পের কর্মী।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৯
Share: Save:

হাসপাতাল, ওষুধ দোকান, নার্সিংহোম

সকাল পৌনে ১১টা নাগাদ আসানসোলের একটি নার্সিংহোমে মাকে ডায়ালিসিস করাতে নিয়ে এসেছিলেন মনি অহলুওয়ালিয়া। কাউন্টারে টাকা জমা দিতে গেলে কর্মী জানালেন পাঁচশো বা হাজারের নোট নেওয়া হবে না। অথচ মনিদেবীর কাছে শুধু পাঁচশোর নোট। আত্মীয়-পরিজনদের খবর দিয়ে ১০০ টাকার নোট আনাতে ঘণ্টা তিনেক পেরিয়ে গেল। তার পরেই হল ডায়ালিসিস করাতে পেরেছেন। মনিদেবীর ক্ষোভ, ‘‘ছ’বছর ধরে এই নার্সিংহোমে মায়ের ডায়ালিসিস করাচ্ছি। কিন্তু আজ ন্যূনতম সাহায্য পেলাম না।’’ চিকিৎসক ছুটি দেওয়া সত্ত্বেও নিকট আত্মীয়কে বাড়ি নিয়ে যেতে পারছিলেন না আসানসোলের বাসিন্দা সঞ্জিব সাঁই। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় দশ হাজার টাকা বিল হয়েছে। কিন্তু পাঁচশো, হাজারের নোট নেওয়া হচ্ছে না। এখন এত ১০০ টাকার নোট কোথায় পাব!’’ নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের যদিও দাবি, সরকারের নির্দেশ মতোই লেনদেন বাতিল করেছেন তাঁরা।

দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে কাঁকসার বিনোদ সাউয়ের স্ত্রীর। তিনি জানান, বাইরে ওষুধের দোকানে কিছুতেই পাঁচশো টাকার নোট নিতে চায়নি। কী ভাবে ওষুধ পাবেন ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। তবে অন্য একটি দোকানের কর্মী সমস্যা দেখে সহযোগিতা করেন। বিধাননগরে এক বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি নির্দেশ মেনে পাঁচশো বা হাজারের নোট নেওয়া হচ্ছে না। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন সারা হচ্ছে। কার্ড না থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত আর্থিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা।

রানিগঞ্জের চিকিৎসক সমরেন্দ্রকুমার বসু জানান, তিনি যে নার্সিংহোমে চিকিৎসা করেন সেখানে দিনে গড়ে ৮০টি শয্যা থাকলেও নোট বাতিলের নির্দেশের পরে রয়েছেন ২১ জন রোগী। তাঁর নিজের চেম্বারে চিকিৎসার জন্য ৬১ জন আগে থেকে নাম লেখালেও এ দিন এসেছেন জনা কুড়ি। তিনি বলেন, “কয়েক জন খুচরোর অভাবে ওষুধ কিনতে পারেননি। আবার ছুটি হয়ে গেলেও কেউ-কেউ নার্সিংহোম ছেড়ে যেতে পারেননি।’’

বাস, ট্রেন, অটো

সকাল পৌনে ৮টা। দুর্গাপুরে ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরার জন্য টিকিটের কাউন্টারে লম্বা লাইন। কাউন্টারে রেলকর্মী জানিয়ে দিলেন, পাঁচশো টাকার নোট নেওয়া যাবে না। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও খুচরো না মেলায় যাত্রীরা হল্লা জুড়লেন। তাঁদের দাবি, সরকারের নির্দেশ মোতাবেক রেলের পাঁচশো টাকা নেওয়ার কথা। রেলকর্মীদের অভিযোগ, বেশির ভাগ যাত্রীই পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট দিয়ে তা ভাঙিয়ে নিতে চাইছিলেন। কিন্তু সবাইকে দেওয়ার মতো খুচরো মজুত না থাকায় তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়। একই পরিস্থিতি দেখা দেয় আসানসোলেও। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা সেখানে ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজারকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টায়। নোট নিয়ে বিশেষ সমস্যা আর দেখা যায়নি। বাসের টিকিট কাটতে গিয়েও মুশকিলে পড়েন অনেক যাত্রী। জরুরি কাজে কলকাতায় যাওয়ার জন্য আসানসোলে এক বেসরকারি সংস্থার বাসের টিকিট কাটতে গিয়েছিলেন অভিষেক মজুমদার। কাউন্টারে পাঁচশো টাকার নোট ঠেকাতেই সটান জানিয়ে দেওয়া হয়, টিকিট মিলবে না। কোনও রকমে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে খুচরো দিয়ে টিকিট কাটেন। ওই পরিবহণ সংস্থার ম্যানেজার অশোক ফৌজদার বলেন, ‘‘নোট বাতিল করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে অনেককেই টিকিট দিতে পারিনি। যাত্রীর সংখ্যাও কমেছে।’’ খুচরো রয়েছে কী না তা আগাম জেনে রিজার্ভের অটোয় যাত্রী তুলেছেন চালকেরা। দুর্গাপুরের অটোচালক সন্তোষ শর্মা, আকাশ সাউরা বলেন, ‘‘খুচরো নেই বলে কয়েকজন যাত্রীকে ছেড়ে দিতে হল।’’

বাজারে পাঁচশোর নোট নিতে দ্বিধা।

পেট্রোল পাম্প

সকাল ৯টা নাগাদ দুর্গাপুরে বিসি রায় রোডের পাশে পেট্রোল পাম্পে মোটরবাইকে তেল নিতে এলেন এক যুবক। দু’শো টাকার তেল ভরে দিলেন পাঁচশো টাকার নোট। পাম্পের কর্মী অনুরোধ করলেন, খুচরো দিতে। যুবকটি ‘নেই’ বলতেই তাঁকে হাতে লিখে রসিদ দিয়ে দিলেন কর্মীটি। জানালেন, এই রসিদ দেখিয়ে তিনি পরে এখান থেকে তেল ভরতে পারেন বা নগদ ফেরত নিতে পারেন। কবিগুরু এলাকায় মহিলা কর্মীদের পরিচালিত পেট্রোল পাম্পে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিলে অন্তত তিনশো টাকার তেল নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কর্মীদের কথায়, ‘‘এক জনকে এর বেশি খুচরো দিতে হলে মুশকিল হবে। তাই এই পথ নিতে হয়েছে।’’ বেনাচিতির এক পাম্প আবার খুচরো না দিলে তেল দিতে নারাজ। পাঁচশো টাকা দিলে পুরো টাকার তেল নিতে বলা হচ্ছে। আসানসোলেও অনেক পাম্পের কর্মীরা জানান, পাঁচশো বা হাজারের নোট দিলে পুরো টাকার তেল ভরতে হবে, খুচরো মিলবে না। বেশ কয়েকটি পাম্পে ক্ষোভ-বিক্ষোভও দেখা দেয়। পাম্প মালিকদের দাবি, বেশির ভাগই পাঁচশো বা হাজারের নোট ধরানোয় তাঁদের কাছেও খুচরোর অভাব দেখা দিয়েছে।

মাছ, সবজি বাজার

দুর্গাপুরে সিটি সেন্টারের ডেলি মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের মাছ সাজিয়ে বসেছিলেন ব্যবসায়ী জগৎকৃষ্ণ পাল। রোজকার মতোই খদ্দেরের ভিড়। পাঁচশো, হাজার টাকার নোটও নিচ্ছেন তিনি। সকাল থেকে বেশ কিছু একশো টাকার নোট নিয়ে বসেছিলেন, খদ্দেরদের ফেরত দিতে। সমস্যা শুরু হল তা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে। পরিচিত খদ্দেরদের ধারেই মাছ দিলেন তখন। অপরিচিতদের ক্ষেত্রে পুরো পাঁচশো টাকার মাছ কেনার জন্য আর্জি জানালেন। জগৎকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘মহাজন না নিলে এই সব নোট পরে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব।’’ দুর্গাপুর স্টেশন বাজার লাগোয়া সেন মার্কেটে সবজির আড়তদার তরুণ পাত্র ও মৃদুল চক্রবর্তীরা জানান, এ দিন পাঁচশো টাকাতেই লেনদেন করতে হয়েছে। কারণ, সবজি কাঁচা সামগ্রী। সময়ে কেনাবেচা না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া আগের দিনের কারবারের টাকা পরের দিন আসে। অনেকে সেই টাকা দিয়েছেন পাঁচশোর নোটে। মহাজনকেও পাঁচশোর নোট দিতে হয়েছে। তবে বাজারে ক্রেতাদের কাছে সবজি বিক্রেতারা আগেই জেনে নিচ্ছিলেন, খুচরো রয়েছে কি না।

মঙ্গলবার রাতে এটিএমে ভিড়।

ব্যাঙ্কে হাজির

সরকারি নির্দেশ মতো এ দিন বন্ধ ছিল সব ব্যাঙ্ক। কিন্তু সব গ্রাহকের তা জানা ছিল না। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ দুর্গাপুরে এসবিএসটিসি গ্যারাজ মোড়ের কাছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় জড়ো হন কয়েকজন পেনশন উপভোক্তা। বছরের এই সময়ে তাঁদের ‘লাইফ সার্টিফিকেট’ জমা দিতে হয়। মনোরমা নাগ এসেছিলেন বীরভূমের দুবরাজপুর থেকে। স্বামী প্রশান্তবাবু ডিপিএলে চাকরি করতেন। ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে পৌঁছে মাথায় হাত। তাঁদের সমস্যা বুঝে ব্যাঙ্কের কর্মীরা জানালেন, প্রমাণপত্র জমা দিতে পারেন, তবে সে জন্য যে ফর্ম লাগে তা দেওয়া হবে না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মনোরমাদেবী, ডিপিএল কলোনির হিমাংশুকুমার মিশ্রেরা। এ দিনই আবার নতুন নোটের খোঁজে ব্যাঙ্কে হাজির হন দু’চার জন। এমনই এক জন ডিপিএল কলোনির সুবোধ সেন। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, এ দিন সেই কাজ হবে না।

টোলে নোটিস

সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ দুর্গাপুর ব্যারাজে গিয়ে দেখা গেল, টোল ট্যাক্স আদায়ের কাউন্টারের সামনের দেওয়ালে হাতে লেখা নোটিস সাঁটানো— ‘পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট দেবেন না’। নীচে আলাদা কালিতে লেখা, ‘মোদীর আদেশানুসারে’। ব্যারাজে গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ ট্যাক্স দিতে হয় ২৬ টাকা। কাজেই এমনিতে ৫০ বা একশো টাকার নোটের কারবার বেশি। কদাচিৎ এক-দু’জন পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দেন। এ দিন অবশ্য নোটিস দেখে তা কেউ করেননি।

ফোন, বিদ্যুৎ বিল

সকাল সাড়ে ১১টা। পানাগড়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার অফিসে বেশ কয়েকজন গ্রাহক ক্ষোভ জানাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, পাঁচশো ও হাজারের নোট নেওয়া হবে না। এই দিনগুলিতে যাঁদের বিল দিতে হবে তাঁরা ১৫ দিন অতিরিক্ত সময় পাবেন। কিন্তু গ্রাহকেরা অনড়। তাঁদের দাবি, দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন। আগাম নোটিস দেওয়া উচিত ছিল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গজগজ করতে করতে ফিরে যান তাঁরা। টেলিফোনের বিল মেটাতে গিয়েও একই রকম সমস্যায় পড়েন গ্রাহকেরা।

মুশকিলে পড়ুয়া

আসানসোল-দুর্গাপুরের বিভিন্ন কলেজে পড়াশোনা করতে আসেন অন্য জেলা ও ভিন্‌ রাজ্যের পড়ুয়ারা। কেউ হস্টেলে, কেউ মেসে থাকেন। মাসের গোড়ায় বাড়ি থেকে হাতখরচের টাকা পেয়েছেন। কিন্তু এখন পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলে তাঁরা পড়েছেন মুশকিলে। মনিপুর থেকে আসানসোল হোমিওপ্যাথি কলেজে পড়তে আসা ছাত্রী সোমচাঁদ লাইসারাম, ভারতি নাওরেমরা জানান, দোকান-বাজারে বড় নোট নিচ্ছে না। পর্যাপ্ত খুচরো নেই তাঁদের কাছে। তাই সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা বলেন, ‘‘এখানে আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তাই বড় নোট কী করে পাল্টাব, চিন্তায় আছি।’’

ধারেই কারবার

কয়লা, বালি, লোহা কারবারে আপাতত ধারেই চলবে কারবার, জানাচ্ছেন কারবারিরা। মোটা টাকার এই কারবারে পাঁচশো, হাজারের নোটই ব্যবহার হয় বেশি। জামুড়িয়ার সাতগ্রাম ও আসানসোলের কালাঝরিয়ার দুই কারবারির কথায়, “আমাদের ধারের চল রয়েছেই, তবে স্বল্পকালীন মেয়াদে। এখন বেশ কিছু দিন তা চলবে।’’ রানিগঞ্জ বণিকসভার কর্তা রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতান জানান, রানিগঞ্জে ১০টির বেশি তেলকল, গোটা পাঁচেক দেশি সাবানের কারখানা, প্রচুর চানাচুর, পাঁপড় তৈরির ক্ষুদ্র সংস্থা, সোনা-রুপোর বড় বাজার আছে। পাণ্ডবেশ্বর, হরিপুর, জামুড়িয়া থেকে এই বাজারে পণ্য কিনতে আসা ছোট ব্যবসায়ীরা নোট নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন এ দিন। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন, জানান রাজেন্দ্রপ্রসাদবাবু।

(তথ্য: সুব্রত সীট, সুশান্ত বণিক, নীলোৎপল রায়চৌধুরী, বিপ্লব ভট্টাচার্য)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cuurency note ATM Petrol pump market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE