এমন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই হাহুতাশ। নিজস্ব চিত্র
গত বছরেও ধুমধাম করে লক্ষ্মীপুজো হয়েছিল। আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি বসেছিল আনন্দের হাট। দুরমুশ হওয়া দোতলা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে বলছিলেন দামোদর রায়। সালানপুরের পাহাড়গোড়ার বাসিন্দা। পরক্ষণেই তাঁর উক্তি, ‘‘আর পুজো হবে না পাঁচ পুরুষের ভিটেতে।’’ কেউ বা এ বারেই শেষ বারের মতো নিজের বাড়িতে পুজোর আয়োজন করছেন।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৭-র ‘কোল বেয়ারিং এরিয়াজ়’ (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) আইনে ২০১৩-য় গ্রামের প্রায় ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে ‘ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড’ (ইসিএল)। উদ্দেশ্য, কয়লা তোলা। ইসিএল সূত্রে জানা যায়, এই আইন বলে জমি অধিগ্রহণের জন্য জমি মালিকের সম্মতির দরকার হয় না। তবে অধিগ্রহণের জন্য মালিককে দিতে হয় পুনর্বাসন বাবদ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও জমির বাজারদর। সেই মতো জমি অধিগ্রহণের পরে ইসিএল কর্তৃপক্ষ গ্রামবাসীদের জমির দাম বুঝে নিয়ে এলাকা ছাড়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। কিন্তু তার পরেও গ্রামবাসীর একটি বড় অংশ ভিটে ছাড়েননি।
শেষমেশ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় ইসিএল। ২০১৮-র ১৯ জুলাই হাইকোর্ট জেলা প্রশাসনকে ওই অধিগৃহীত জমি খালি করে ইসিএল-কে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর পরে জমির বর্তমান দাম বাবদ প্রায় তিন কোটি টাকা আসানসোল আদালতে জমা করে ইসিএল। জমি ‘দখল’ মুক্ত করতে ২২ অগস্ট পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় উচ্ছেদ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় ১০টি বাড়ি।
তেমনই একটি বাড়ি দামোদরবাবুদের। এখন থাকেন পাশের গ্রামে, ভাড়াবাড়িতে। শনিবার সকালে এসেছিলেন গ্রামে, নিজের বাড়ির কাছাকাছি। কেন? ‘‘আমি ক্ষতিপূরণ নিইনি। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আসলে লক্ষ্মীপুজোর দিনটা এলে আর এখানে না এসে পারি না,’’ গলা বুজে আসে দয়ারামবাবুর। গ্রামের শেষ প্রান্তে ছেলেকে নিয়ে এখনও শ্বশুরের ভিটে কামড়ে পড়ে রয়েছেন শীলা রায়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় ৪১ বছর গ্রামে আছি। ক্ষতিপূরণ নিয়ে নিয়েছি। এ বারেই শেষ পুজো আমার ঘরে।’’
একই ভাবে অন্য বছরের তুলনায় শেষ বারের মতো বাড়িতে আলপনা আঁকছিলেন শিপ্রা রায়। ভিটে-বদল, ক্ষতিপূরণ, উচ্ছেদ— এই শব্দগুলো প্রভাব ফেলেছে বোলকুণ্ডার বাসিন্দা লাল্টু চট্টোপাধ্যায়ের জীবনেও। পেশায় পুরোহিত এই মানুষটি জানান, ‘‘গত বছরেও ২২টি পরিবারে ধুমধাম করে পুজো হয়েছে। এ বার মাত্র তিনটি বাড়িতে পুজো হবে, তা-ও কোনওমতে। গ্রাম না থাকলে রোজগারই বা হবে কী করে?’’
ইসিএলর সালানপুর এরিয়া কার্যালয় অবশ্য জানায়, প্রায় ২৫ লক্ষ টন কয়লা মজুত রয়েছে এলাকায়। আগামী তিন বছরের মধ্যে তা তোলা হবে। শনিবারও এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, যন্ত্র নামিয়ে চলছে কয়লা তোলার প্রস্তুতি। ইসিএলের দাবি, সব নিয়ম মেনে, আইন অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy