আসানসোলের পোলো ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রবিবার। ছবি: শৈলেন সরকার।
এ যেন এক উৎসবের দিন।
সুদিন ফেরার আশায় মুখে হাসি সবার মুখে। তার সঙ্গে পাওনা আবার প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি। আসানসোল-বার্নপুরে রবিবারটা তাই উৎসব-আনন্দেই কাটালেন ইস্কোর শ্রমিক-কর্মীরা। সামিল হলেন শহরবাসীও। তাঁদের কথায়, ‘‘এ রকম দিন তো আর সচরাচর আসে না।’’
প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই প্রস্তুতি তুঙ্গে উঠেছিল শহরে। ডজন খানেক তোরণ আর হাজার দশেক প্রধানমন্ত্রীর কাট আউটে মুড়ে ফেলা হয় শিল্পশহর। কচি কলাপাতা ও সাদা রঙে সেজে উঠেছিল পার্ক, পাঁচিল, গাছপালা। রঙিন আলোয় ঝলমল করেছে ইস্পাত শহর। শহরের অনেকেরই দাবি, এর আগে এই রকম অনুষ্ঠান কবে দেখেছেন, মনে পড়ে না। তাই সকাল সকাল হাতের কাজ সেরে তাঁরা হাঁটা দিয়েছিলেন পোলো মাঠের দিকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের আকাশে দেখা দিল প্রধানমন্ত্রীর চপার। ততক্ষণে অবশ্য সভাস্থল প্রায় ভর্তি। বাইরেও বহু লোক।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিট প্রধানমন্ত্রীর চপারের কনভয়ের প্রথমটি নামে সভাস্থলের পাশে আসানসোল স্টেডিয়ামের অস্থায়ী হেলিপ্যাডে। সভাস্থলে হাজির হাজার বিশ মানুষ দূর থেকে চপারের আওয়াজ শুনতে পেয়েই সোল্লাসে চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন। এর মিনিট খানেকের মধ্যে বাকি চপারগুলিও এসে পৌঁছল। চপার থেকে নামার পরে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় ছুটল কারখানার দিকে।
ইস্কোর তরফে অতিথিদের সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে সভাস্থলে ঢুকতে অনুরোধ করা হয়েছিল। তার অনেক আগেই নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসেছিলেন এক ইস্কো কর্মীর স্ত্রী সমাপ্তিকা কউর। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার রাতেই বাড়ির অর্ধেক কাজ গুটিয়ে রেখেছিলাম। রবিবার ভোরে উঠে বাকি কাজ সেরে এখানে চলে এসেছি।’’ সভায় যোগ দিতে এত উত্তেজনা কেন? সমাপ্তিকার উত্তর, ‘‘দেশের উন্নয়নের কাজে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন জোগাতেই সভাস্থলে আসা।’’ ইস্কোর কর্মী কল্যাণ সাহা আবার বলেন, ‘‘এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম প্রায় ২৫ বছর। সেই সাধ পূরণ হয়েছে। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে এখানে এসেছি।’’ নিজের কর্মস্থলের সাফল্যে তাঁর বাবা যে এত আনন্দিত, তা সভায় এসে টের পেয়েছে বলে জানাল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অনুষ্কা শ্রীবাস্তব। সে বলে, ‘‘প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে এসেছি। আসানসোলের জন্য তিনি আরও কিছু করুন, এই আশায় এখানে এসেছি।’’ এ দিন সকাল থেকেই বার্নপুর রোডে যান চলাচল শিথিল করেছিল প্রশাসন। ফলে পায়ে হেঁটেই মানুষজনকে সভাস্থলে আসতে হয়েছে। কষ্ট হলেও তাঁদের মুখে সব সময়েই হাসি লেগে ছিল।
নামল প্রধানমন্ত্রীর চপার।
প্রায় আধ ঘণ্টা কারখানায় কাটিয়ে সকাল ১১টা বেজে ২০ নাগাদ প্রধানমন্ত্রী সভাস্থলে আসেন। সমুদ্রগর্জন করে ওঠে জনতা। উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে পাল্টা অভিনন্দন ছুঁড়ে দেন প্রধানমন্ত্রীও। মিনিট কয়েক পরে মুখ্যমন্ত্রী সভাস্থলে উপস্থিত হতেও ফের গর্জন। উঠে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি জোড় হাত করে সৌজন্য বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখতে ওঠার আগে পর্যন্ত বারবারই সভাস্থলে উঠেছে ‘মোদী মোদী’ আওয়াজ। তাঁর কথায় ঘুরেফিরে যত বারই আসানসোল বা কলকাতার নাম এসেছে, ঝড় উঠেছে হাততালির।
এত আড়ম্বরের মাঝেও অবশ্য কিছুটা বিষাদের ছাপ ছিল ইস্কোর সম্প্রসারণ প্রকল্প লাগোয়া পুরুষোত্তমপুর গ্রামে। প্রকল্প রূপায়ণের জন্য বেশির ভাগ জমি দিয়েছিলেন এই গ্রামের বাসিন্দারাই। রবিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাসিন্দাদের প্রায় কেউই সভায় যাননি। গ্রামে জমি নিয়ে আন্দোলনের জন্য গঠিত কমিটির সম্পাদক চন্দ্রশেখর রায় বলেন, ‘‘আমাদের এখানেই ইস্কোর নতুন প্রকল্পের জন্ম। অথচ, আমাদেরই কোনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাই যাইনি।’’ খেদ রয়েছে আরও। তাঁদের দাবি, আশ্বাস মতো গ্রামের ১৭৬ জন জমিদাতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। তাঁরা জানান, যে দিন বেকার যুবকেরা চাকরি পাবেন, তাঁরা সে দিনই উৎসব করবেন।
এ দিন পোলো মাঠের সভা শেষে কাল্লা মোড়ে একটি সরকারি অনুষ্ঠান করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনের উদ্বোধন-সহ নানা প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ইস্কোর সম্প্রসারণ হত না যদি না আমরা তিন হাজার একর জমি বিনা পয়সায় দিতাম।’’ মমতার এই দাবি নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তথা সিটু নেতা বংশোগোপাল চৌধুরীর পাল্টা দাবি, ‘‘জমি দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। দাম মিটিয়েছে ইস্কো। উনি (মমতা) সেই সময়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে বাধা দিয়েছিলেন। এখন তা ঢাকতে মিথ্যে কথা বলছেন।’’
তবে শুধু সম্প্রসারণ প্রকল্পেই শেষ নয়, ইস্কো নিয়ে আরও আশার কথা শুনিয়েছেন ইস্পাতমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এখানে আরও ষোলো হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। দুর্গাপুরের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে।’’
ছবিগুলি তুলেছেন শৈলেন সরকার ও ওমপ্রকাশ সিংহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy