E-Paper

কয়লা-শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পরেই শুরু চুরি

প্রবীণ পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আসানসোলের অশোক অরোরার (ডাবল এ নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে প্রথম কয়লা চুরির অভিযোগ ওঠে।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:২৫
কয়লার বেআইনি কারবার শুরু সেই ১৯৭৩ সাল থেকে।

কয়লার বেআইনি কারবার শুরু সেই ১৯৭৩ সাল থেকে। — ফাইল চিত্র।

কয়লা-শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ ১৯৭৩-এ। কয়লা-শিল্পাঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতদের মতে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে কয়লার বেআইনি কারবার। যত দিন গড়িয়েছে, রং-রূপে বদল ঘটেছে এই কারবারের। এসেছে নানা নাম, নানা পর্যায়। তবে এই কারবারের সঙ্গে পরিচিতরাই জানাচ্ছেন, সদ্য নিহত কয়লা কারবারি রাজেশ ওরফে রাজু ঝায়ের মতো এত দীর্ঘ সময় জুড়ে কয়লা কারবারের বেআইনি সাম্রাজ্যে আধিপত্য প্রায় কারও ছিল না। এই কারবারের আকার বৃদ্ধিতেও রাজুর ভূমিকাই ছিল প্রধান, মনে করছেন তদন্তকারীরা। এই কারবার যত গড়িয়েছে, তত পাল্লা দিয়ে জেলায় বেড়েছে ধসের সংখ্যাও।

প্রবীণ পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আসানসোলের অশোক অরোরার (ডাবল এ নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে প্রথম কয়লা চুরির অভিযোগ ওঠে। কোলিয়ারির সাইডিং থেকে কয়লা চুরি করে বারাণসী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ‘ডাবল এ’-র টোকেন দেখালে বেআইনি কয়লা পরিবহণ হত বলে অভিযোগ। ৮০-র দশকের শুরু থেকে পুলিশের খাতায় উঠে আসে দুর্গাপুরের অজিত পাল নামে এক জনের নাম। অভিযোগ, অজিত একটি ‘দাদাগিরি বাহিনী’ তৈরি করেছিলেন। রাস্তা দিয়ে কয়লার গাড়ি পারাপার করতে হলে, এই বাহিনীর থেকে গাড়ি পিছু একশো টাকার টোকেন কিনতে হত। তা না হলেই, জুটত মার, অভিজ্ঞতা এক চালকের।

ক্রমে রানিগঞ্জের পঞ্জাবি মোড় এলাকার অলোক দত্ত, সরযূ উপাধ্যায়দের নাম সামনে আসে। কিন্তু ৯০-এর দশকের শেষে একটি অশান্তিতে তিন জন নিহত হন। জেল খাটেন সরযূর অনুগামী দিলীপ সিংহ এবং তাঁর বিরোধী লক্ষ্ণণ যাদব।এই পরিস্থিতিতে কয়লা কারবারে রাশ হারান সরযূ। সে জায়গায় চলে আসেন রামু পাঁজা, কানু চক্রবর্তী এবং বালদেবের গোষ্ঠী। কানু খুন হয়ে যান। এর পরে সরযূফের রাশ নিতে থাকেন বলে দাবি। এই-পর্বে সরযূ ‘প্যাড’-প্রথা শুরু করেন। প্রতিটি ট্রাক-পিছু ছ’শো টাকার প্যাড নিতে হত।

তবে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পরে থেকে ৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত কয়লা চুরিটা ঘটত কুয়ো খাদ তৈরি করে এবং সাইডিং থেকে কয়লা পাচার করে, দাবি পুলিশ ও ইসিএলের প্রাক্তন কর্তাদের একাংশের। তাঁরা জানান, নতুন শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু হয় অবৈধ খাদানের রমরমা। আর সে সূত্রেই পুলিশের খাতায় সামনে আসতে শুরু করে রাজুর নাম। যদিও, রাজুর নাম কয়লা-কারবারে শোনা গিয়েছিল ৯০-এর দশক থেকেই। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তিনি সরযূর দলে যোগ দেন। বেআইনি কয়লা কারবারে রাজুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৯৯। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, ওই বছরের শুরুতে রাজু সরযূকে অন্ধকারে রেখে বেআইনি কয়লা বোঝাই একটি ট্রাক পাচার করে দেন। বিষয়টি জানতে পেরে সরযূর লোকজনের হাতে বেধড়ক মার খান রাজু। তিনি আশ্রয় নেন দুর্গাপুরে। কিছু দিনের মধ্যেই রাজু ও তাঁর বাহিনী সরযূর কয়লা বোঝাই একটি ট্রাক জ্বালিয়ে দেন বলে অভিযোগ। এর পরেই শুরু হয়রাজুর উত্থান। পুলিশের খাতায় অভিযোগ, অন্ডাল, রানিগঞ্জে ওসিপি-র আকারে ইসিএলের লিজ় হোল্ড (যেখানে মাটির তলায় কয়লা আছে) এলাকায় অবৈধ খনি তৈরি করে কয়লা পাচার করতে শুরু করেন রাজু। পাশাপাশি, প্যাড বিষয়টির পরিমার্জন, তাতে নির্দিষ্ট সঙ্কেত ব্যবহার রাজুর হাত ধরেই শুরু হয়। কয়লা কারবারিদের মধ্যে প্যাড-পদ্ধতিটি ‘জনপ্রিয়’ হয় রাজুর হাত ধরেই। এ ভাবে ভাবে নতুন শতাব্দীর গোড়া থেকেই রাজু হয়ে ওঠেন বেআইনি কয়লা-সাম্রাজ্যের বেতাজ বাদশা। অভিযোগ, তৈরি করেন কয়লা সিন্ডিকেট। পুরুলিয়ায় অনুপ মাজি (লালা), মধুকুণ্ডায় গুরুপদ মণ্ডল, বাঁকুড়ায় নীরদ মণ্ডল, বীরভূমে ইন্দু সিংহ, সালানপুরে জয়দেব মণ্ডল, জামুড়িয়ায় বিকাশ অধিকারী— ক্রমে বড় হতে থাকে রাজুর দলবল। বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম— রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার কয়লা কারবারে ২০১১ পর্যন্ত রাজুর কয়লা-সাম্রাজ্য চলেছিল বলেই দাবি। রাজ্যে পালাবদলের পরে, রাজুর জায়গা নেন লালা। তবে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি কয়লা-পাচারের তদন্ত শুরু করতেই লালার কারবারে ভাঁটা পড়ে। ২০২২-এর শেষ থেকে রাজু ফের হৃত-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করছিলেন বলে দাবি। (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Coal Mine Raniganj

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy