পুবে দামোদর, পশ্চিমে অজয়, উত্তরে বরাকর। তিন দিকে নদী দিয়ে ঘেরা অবিভিক্ত বর্ধমান জেলার এই পশ্চিম এলাকাটি ভূমিরূপ, মাটির গঠন, নদীদের স্বভাব, অরণ্য-সহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশের নিরিখে পুব দিকের গাঙ্গেয় সমভূমির থেকে ভিন্ন। ছোট-বড় সব নদীই উঠেছে মানভূমি থেকে। লাল কাঁকুরে মাটির উপরে ঘন পত্রমোচী বন। নীচে ছোটবড় পশু। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন, সংস্কৃতিও ছিল আলাদা। জঙ্গলে ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই নদীবৃত এলাকার ইতিহাস বা প্রাক্ ইতিহাসের শুরু। পরবর্তী সময়ে উপনিবেশিক নগর সভ্যতা এখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও তার কোলের মানুষ, উভয়কেই অগ্রাহ্য করে ঘটাল ‘শিল্পায়ন’।
সুঘন অরণ্যের নীচে আবিষ্কৃত হল খনির পর খনি আর সাঁওতাল বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহের এই ভূখণ্ডের ইতিহাস গেল পাল্টে। ‘লোহা-কয়লার এলাকা’ নামের গৌরবে মহিমান্বিত অঞ্চলের খ্যাতি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল। শুধু হিসেবে রইল না এখানকার নিজস্ব মানুষদের লুন্ঠিত-বিপর্যস্ত জীবনের কথার। এক কালে যে সমৃদ্ধ ভূখণ্ডের অর্থময় নাম ছিল ‘বর্দ্ধমান’, যা নিয়ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, সেখানকার আদি মানুষের জীবন তছনছ হতে লাগল নিরন্নে, নিষ্পাদপ কুলি-বসতিতে, অপরিচিত দূরারোগ্য ব্যাধিতে। মাত্র দু’শো বছরে নদী-পুকুর-জঙ্গল সমৃদ্ধ এলাকার নিজস্ব জীবন চলে গেল সামাজিক স্মৃতির বাইরে। বিস্মৃত হল বৃষ্টির জলকে উচ্চাবচ জমিতে ধরে রাখার সংরক্ষণ ও কৃষি। বাঁধা পড়ল একের পরে এক নদী। তির-ধনুকের প্রতিরোধ উড়ে গেল বন্দুকের মুখে।
সময় থেমে থাকে না। থেমে থাকে না মানুষের সমাজও। এককালে যাঁরা এসেছিলেন ‘বাইরের লোক’ হয়ে, নিতান্তই জীবিকার প্রয়োজনে, কালক্রমে তাঁরাও হয়ে উঠলেন এখানকারই মানুষ। তাঁদের সংস্কৃতির মিশেলে গত কয়েক দশকে গড়ে উঠল এক মিশ্র সংস্কৃতি। তার মধ্যে বৈচিত্র জুগিয়েছে শিল্পোদ্যোগের দরুণ এসে পড়া উপাদান। আসানসোল, রানিগঞ্জ প্রাচীন রেলশহর হওয়ার দরুণ ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজের এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব খেয়াল করা যেত এ সকল অঞ্চলে। খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর চোখে পড়ার মত প্রাধান্যের কারণ অবশ্য আরও প্রাচীন। যে কারণে এ অঞ্চলে ছেলেদের থেকে মেয়েদের স্কুলগুলির বয়স বেশি। তার কারণ, নানা আদিবাসী বিদ্রোহের পরে বিদেশি অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রচুর সংখ্যায় আদিবাসীদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। একই সঙ্গে নিয়ামতপুরের মত এলাকায় আছেন কয়েকশো বছরের প্রাচীন ‘রইস মুসলিম’ ঘরানার কিছু প্রত্ন-মানুষজন।
কোলিয়ারিতে কাজ করতে দেশের নানা জায়গা থেকে আসা অসংখ্য মানুষ এখানে গড়ে তুললেন ‘ছত্তীশগঢ়ি ধাওড়া’, ‘নেপালি বস্তি’র মতো বহু মিনি জনপদ। সাঁওতাল গ্রামের পাশাপাশি আছে বিহারি ভূমিহীন কৃষকদের ঝোপড়ি। ‘কোলুয়ারি’ আর কারখানা তৈরি করেছে ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’র এক অতি বিচিত্র সংস্করণ। এমন নয় যে, এ সকল ভিন্নতা কোনও জল-অচল দূরত্ব তৈরি করেছিল বৃহত্তর, ভিন্নতর স্বভাব-প্রকরণের পূর্বতন জেলাটির সঙ্গে। কিংবা এমনও নয় যে ছিন্ন হয়ে যাবে কোনও বাস্তব বন্ধন। এ শুধু প্রশাসনিক ভাগ। আর সেই সঙ্গে বহুদিনের এক স্বীকৃতি-দাবির বাস্তবায়ন।
নতুনের কাছে সর্বদাই শ্রেয়তর হবার অপেক্ষা থাকে। সেই প্রসন্ন শান্ত ‘অরণ্যকা’ ফিরবার অলীক আশা নয়, কেবল চার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির জন্যে দু’শোর বেশি বৃক্ষচ্ছেদনের দাহ যেন আর না সহ্য করতে হয়। এই পাথুরে জমিতেও নিত্য-চঞ্চল নদীগুলি যেন খুন না হয়ে মাটি চাপা পড়ে। মনোহীন উর্ধ্বশ্বাস গতিকেই পথ ভাবার বদলে নতুন জেলাটির সাধারণ মানুষ যেন ভাবতে পারে আরেকটু আনন্দময় ভাবে বাঁচার কথা।
সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy