Advertisement
E-Paper

স্বপ্নের এভারেস্টেই নিখোঁজ পরেশ

দিনটা ছিল ৭ এপ্রিল। বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর সারদাপল্লির বাসিন্দা প্রণব পালের স্পষ্ট মনে পড়ছে ভাইয়ের কথাগুলো। ‘‘দেখিস দাদা, এ বার এভারেস্ট জয় করবই।’’— বাড়ি থেকে বেরনোর আগে দাদাকে বলেছিলেন সুভাষ পাল (৪০)। ভাইয়ের অদম্য জেদ দেখে গর্বে বুক ভরেছিল পর্বতারোহনের প্রশিক্ষক প্রণবের। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আদৌ পা রাখতে পেরেছিলেন কি না সে প্রশ্ন থাকলেও এটা পরিষ্কার যে স্বপ্নপূরণে প্রাণপণ লড়াই জারি রেখেছিলেন সুভাষ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপ্লব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০০:৫২
পরেশ নাথের বাড়ির সামনে ভিড় উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীদের। নিজস্ব চিত্র।

পরেশ নাথের বাড়ির সামনে ভিড় উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীদের। নিজস্ব চিত্র।

দিনটা ছিল ৭ এপ্রিল। বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর সারদাপল্লির বাসিন্দা প্রণব পালের স্পষ্ট মনে পড়ছে ভাইয়ের কথাগুলো। ‘‘দেখিস দাদা, এ বার এভারেস্ট জয় করবই।’’— বাড়ি থেকে বেরনোর আগে দাদাকে বলেছিলেন সুভাষ পাল (৪০)।

ভাইয়ের অদম্য জেদ দেখে গর্বে বুক ভরেছিল পর্বতারোহনের প্রশিক্ষক প্রণবের। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আদৌ পা রাখতে পেরেছিলেন কি না সে প্রশ্ন থাকলেও এটা পরিষ্কার যে স্বপ্নপূরণে প্রাণপণ লড়াই জারি রেখেছিলেন সুভাষ। সোমবার সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই অভিযানেই প্রাণ গিয়েছে তাঁর। এখনও নিখোঁজ দুর্গাপুরের পর্বতারোহী পরেশ নাথ। স্বামীর সঙ্গে সবিতাদেবীর শেষ কথা হয় ১৭ মে। বলেছিলেন, ‘‘আমি ঠিক আছি। এ বার এভারেস্টের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি।’’ তার পরে আর কিছু জানা নেই কারও।

দুর্গাপুরের পরেশবাবুর পরিবার ২১ মে সংবাদমাধ্যমে খবর পান ঘরের ছেলে এভারেস্ট জয় করেছেন। কিন্তু সে আনন্দ স্থায়ী হয়নি। সে দিনই বেলার দিকে খবর আসে, পরেশবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। উদ্বেগের সেই শুরু।

কখনও খবর আসে, পরেশবাবু-সহ সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছে। তাঁরা ক্যাম্প চার থেকে ক্যাম্প ২-এ ফিরছেন। এ ভাবেই পেরিয়ে যায় শনিবার রাত থেকে রবিবার রাত। রবিবার রাতে পরেশবাবুর স্ত্রী সবিতাদেবী জানতে পারেন, স্বামী ভাল আছেন। কিন্তু যতক্ষণ না নিজে কথা বলতে পারছেন ততক্ষণ দুশ্চিন্তা কাটছে না তাঁর। সোমবার সকাল থেকে ফের নিখোঁজের খবর চাউর হতেই ভিড় জমতে শুরু করে পরেশবাবুর বাড়ির সামনে। প্রতিবেশী থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন একে একে সকলেই আসতে শুরু করেন। ভিড় জমে যায় বাড়ির সামনের রাস্তায়। পথচলতি মানুষও দাঁড়িয়ে পড়েন।

তবে এ দিন আর পরেশবাবুর স্ত্রী-র সঙ্গে কথা বলা যায়নি। প্রতিবেশীরা জানালেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নানা খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পর থেকে ভেঙে পড়েছেন সবিতাদেবী। সেই কারণে বাইরের কাউকে বাড়ির ভিতরে যেতে নিষেধ করছেন প্রতিবেশী থেকে বন্ধুবান্ধবরা। সোমবার বাড়ির বাইরে বের হতে দেখা যায়নি সবিতাদেবী ও তাঁর ছেলে অদ্রিশেখরকে। পরেশবাবুর দীর্ঘ দিনের বন্ধু প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, দুর্গাপুরের দুই পর্বতারোহীকে কাঠমাণ্ডু পাঠানো হয়েছে। ততক্ষণ শুধু উদ্বেগ, আর অপেক্ষা। পরেশবাবুর এক প্রতিবেশীর কথায়— ‘‘এ ছাড়া আমাদের কী-ই বা করার আছে!’’

শনিবার ঘরের ছেলের এভারেস্ট জয়ের খবরে গর্বের শেষ ছিল না বাঁকুড়াবাসীর। প্রশাসনিক মহল থেকে সাধারণ মানুষ সর্বস্তরেই চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন সুভাষ। সেই ছবিটা আমূল বদলে গেল দু’দিনেই! সোমবার সকালে টিভিতে সুভাষের মৃত্যুর খবরে হতাশা ছড়ায় শহরে। কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হন তাঁর বাড়িতে। সেখানে তখন শুধুই কান্না, আর্তনাদ। সুভাষের স্ত্রী বিশাখাদেবী বাড়ির উঠোনে ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন! মাকে কী ভাবে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না সুভাষের বছর এগারোর মেয়ে সুশ্রীতা। সুভাষবাবুর বাবা ভক্তদাস পালের একটাই আর্তি— “ছেলেটার মুখটা যেন দেখতে পাই!’’

এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্নপূরণ করতে কী করেননি পেশায় গাড়ি চালক সুভাষ! পড়শির কাছে লক্ষাধিক টাকা ধার করেছেন। স্ত্রী-র গয়না বন্ধক দিয়েছেন। সাহায্যের আশায় প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। পথে নেমে অনুদানও সংগ্রহ করেছেন। বাঁকুড়া এক্সপ্লোরেশন নেচার সংস্থার সদস্য সুভাষবাবু। দাদা প্রণব ওই সংস্থার ট্রেনার। ভাইকে পর্বতারোহনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে প্রণববাবু বলছিলেন সেই কথা। বলছিলেন, ‘‘ওর জন্য বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটাকে আর ফিরে পেলাম না। সে আক্ষেপ এ জীবনে আর যাবে?” ভাইয়ের মৃত্যুশোকের পাশাপাশি তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা কাটছে না প্রণববাবুর। তাঁর কথায়, “ভাই গাড়ি চালাতো। আমি ইলেকক্ট্রিকের মিস্ত্রি। পরিবারের আর্থিক অনটন নিত্য সঙ্গী। ভাইয়ের মেয়ে ও স্ত্রী-র ভবিষ্যৎ বড় প্রশ্নের মুখে পড়ল।”

বাঁকুড়া এক্সপ্লোরেশনের সদস্য সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জানালেন, তিনি সুভাষদার কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মাউন্ট ইউনাম অভিযানে তাঁর সঙ্গীও ছিলেন। সিদ্ধার্থশঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘পাহাড়ে চড়ার বিষয়ে দক্ষতা ছিল তাঁর। কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করতে হয় তা ওনার কাছেই শিখেছি।’’ প্রিয় দাদার মৃত্যু মানতে পারছেন না তিনি। সুভাষের পড়শি শেখ আলিমুদ্দিনের কথায়, “পাড়ায় সবাই ভাল ব্যবহারের জন্য ওকে ভালবাসত। আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াত।’’ মগরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র জানান, পর্বতে ওঠার প্রশিক্ষণ দিতে তাঁর স্কুলে এসেছিলেন সুভাষ। তখন থেকেই পরিচয়। মুকেশবাবুর কথায়, ‘‘আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা ছিল ও। বিশ্বাসই করতে পারছি না প্রাণবন্ত ছেলেটা আর নেই।”

সোমবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর বলছে সুভাষের দেহ বেস ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা যায়নি। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘বেস ক্যাম্পে সুভাষবাবুর দেহ আসার পরেই চপারে করে তা কাঠমাণ্ডু নিয়ে আসা হবে। সেখান থেকে বিমানে দেহ আনা হবে কলকাতায়।’’ জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছি। কিন্তু বেস ক্যাম্প পর্যন্ত দেহ না আসা পর্যন্ত কিছুই করা যাবে না।”

Paresh Nath mountaineer missing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy