Advertisement
E-Paper

টাঙ্গির সঙ্গে গুলি, দ্বন্দ্বই কি পিছনে

কালনার সুলতানপুর পঞ্চায়েতের সেই প্রধান সুকুর শেখ (৫২) খুন হয়ে গেলেন নিজেই। শনিবার বিকেলে তিনি ও তাঁর অনুগামী বাপন শেখ (৩২) গুলিবিদ্ধ হন। সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় বাপনের। কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানো হলে রাতে সেখানেই মৃত্যু হয় সুকুরের।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮ ০১:১৬
শনিবার সন্ধ্যায় এখানেই গুলি করা হয় দু’জনকে। নিজস্ব চিত্র

শনিবার সন্ধ্যায় এখানেই গুলি করা হয় দু’জনকে। নিজস্ব চিত্র

মাস চারেক আগে পঞ্চায়েত ভবনের সামনে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মূর্তি বসেছিল তাঁর উদ্যোগে। উদ্বোধনের দিন তিনি জানিয়েছিলেন, এলাকায় গাঁধীজি অহিংসার বার্তা ছড়িয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ। কালনার সুলতানপুর পঞ্চায়েতের সেই প্রধান সুকুর শেখ (৫২) খুন হয়ে গেলেন নিজেই। শনিবার বিকেলে তিনি ও তাঁর অনুগামী বাপন শেখ (৩২) গুলিবিদ্ধ হন। সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় বাপনের। কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানো হলে রাতে সেখানেই মৃত্যু হয় সুকুরের।

শাসকদল ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০১৩ সালে সুকুর সুলতানপুর পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়ার পর থেকেই তাঁর ও কালনা ১ পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ সাদেক শেখের গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল শুরু হয়। সুকুরের গ্রাম ভাটরার পাশে বেলেডাঙায় বাড়ি সাদেকের। এই ক’বছরে দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে বচসা থেকে মারপিট, সে নিয়ে পুলিশে অভিযোগও হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্ব নানা কর্মসূচিতে দু’পক্ষকে বারবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু দ্বন্দ্ব মেটেনি।

তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, বছর দুয়েক ধরে পঞ্চায়েত এলাকায় সাদেক খানিকটা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তবে পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আসায় পুরনো কর্মীদের উজ্জীবিত করেন নেতৃত্ব। মাস পাঁচেক আগে থেকে সাদেক আবার খানিকটা সক্রিয় হন। অভিযোগ, তার পর থেকে ফের দু’পক্ষের মধ্যে গোলমাল পাকে। সপ্তাহ দুয়েক আগে সুলতানপুরে বোমাবাজি হয়। পুলিশ দু’পক্ষের চার জনকে গ্রেফতার করে। সম্প্রতি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বন্ধে সুকুর ও সাদেককে নিয়ে বৈঠক করেন দলের নেতারা। তবে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি, শনিবার তার প্রমাণ মিলল বলে মনে করছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই।

অহিংসার বার্তা দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েতে এই মূর্তি বসিয়েছিলেন প্রধান সুকুর শেখ। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

বৃহস্পতিবার কালনা ১ ব্লকের বুলবুলিতলায় পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে ব্লক সম্মেলন করে তৃণমূল। সেখানে সাদেক-গোষ্ঠীর লোকজন যাননি। তবে সুলতানপুর থেকে অনেক কর্মীকে হাজির করিয়ে দলীয় নেতৃত্বের প্রশংসা কুড়োন সুকুর। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, সুকুর-বিরোধী গোষ্ঠী তাতে চাপে পড়ে যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার সুলতানপুর এলাকায় তৃণমলের দু’টি বৈঠক হয়। সুলতানপুরে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন সুকুর নিজে। সাদেকের অনুগামীরা পঞ্চায়েত ভবনের কাছে এক জায়গায় বৈঠক করেন। সেখানে ছিলেন এলাকার জেলা পরিষদ সদস্য শান্তি চালও।

এই দু’টি বৈঠক নিয়ে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে সারা দিনই চাপান-উতোর ছিল এলাকায়। সুকুরের গোষ্ঠীর লোকজন জানান, বিকেল ৫টা নাগাদ বৈঠক শেষে তাঁরা হরিশঙ্করপুর মোড়ে চা খেতে যান। অনেক লোক থাকায় বিভিন্ন চায়ের দোকানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেন তাঁরা। সেই সময়ে আচমকা এক দল দুষ্কৃতী হামলা চালায়। ঘটনাস্থলে থাকা তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, ওই দুষ্কৃতীদের হাতে রিভলবার, টাঙ্গি, কাঠ ছিল। প্রথমে বাপনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে গুলি করা হয়। সুকুর কাছেই ছিলেন। তাঁকে টাঙ্গি দিয়ে মারার পরে গুলি করে দুষ্কৃতীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সুকুর দুষ্কৃতীদের মারধর না করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও কান দেয়নি তারা। নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে তৃণমূল কর্মী চিন্টু শেখ বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের মধ্যে দু’জন ওই মোড়ে একটি বিটরা-মেমারি রুটের বাস থেকে নামে। আর জনা পনেরো হেঁটে এসেছিল।’’ ঘটনাস্থলে ছিলেন সুকুরের ভাইপো সুমন আলি শেখ। তাঁর কথায়, ‘‘আচমকা হামলায় আমরা হকচকিয়ে যাই। দুষ্কৃতীরা গুলি ছোড়ায় পাশে জমি দিয়ে ছুটতে থাকি।’’ দুষ্কৃতীরা পালানোর পরে তাঁরা সুকুর ও বাপনকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়।

ঘটনার কারণ নিয়ে জেলা তৃণমূলেও মতান্তর রয়েছে। এক পক্ষের দাবি, পরিকল্পনা করেই হামলা চালানো হয়েছে। আর এক পক্ষের দাবি, এলাকায় আগে থেকেই উত্তেজনা ছিল। একই দিনে দু’পক্ষের বৈঠক থাকায় হামলার আশঙ্কায় সুকুর-বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছিল। হরিশঙ্করপুর মোড়ে দু’পক্ষ সামনাসামনি পড়ে যাওয়ায় গোলমাল বেধে যায়।

রবিবার এলাকায় ছিল কার্যত বন্‌ধের চেহারা। পুলিশের টহল রয়েছে। ঘটনাস্থলে রক্তের দাগ রয়েছে এ দিনও। কাঠ দিয়ে সেই জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনা নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। এ দিন বিকেলে বাপনের বাবা মেহের আলি শেখ কালনা থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে সাদেক শেখ, শান্তি চাল-সহ তৃণমূলের ২৭ জনের নাম রয়েছে।

শনিবার ঘটনার পরে ফোনে সাদেক বলেছিলেন, ‘‘একটি গোলমালের খবর পেয়েছি। আমি এলাকায় নেই। খোঁজ নিচ্ছি।’’ রবিবার দিনভর আর তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি। শান্তিবাবু বলেন, ‘‘দলের কিছু লোকজনের ডাকে ওই এলাকায় একটি বাড়ির উঠোনে এক বৈঠকে গিয়েছিলাম। তা শেষ হলে বাড়ি ফিরে আসি। পরে শুনি, গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে।’’

শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দলে জেলার নানা প্রান্তে মাঝে-মধ্যেই গোলমাল বাধছে। জাহের শেখ, ডালিম শেখের মতো কয়েকজন নেতা-কর্মী খুনও হয়েছেন। পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার আগেই ফের তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে খুনের অভিযোগ ওঠায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন দলের কর্মীদের অনেকেও। জেলা তৃণমূল সভাপতি স্বপন দেবনাথ অবশ্য এই আশঙ্কা মানতে নারাজ। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দাবি করে রবিবার তিনি বলেন, ‘‘যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে তারা তৃণমূলের কর্মী বলে আমি মনে করি না। বিরোধীরা সাদেককে সঙ্গে নিয়ে এই কাজ করেছে। পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে।’’ কালনার সিপিএম নেতা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ সুলতানপুরে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে। এই ঘটনা শাসকদলের দ্বন্দ্বেই ঘটেছে, বিরোধী-যোগের কোনও প্রশ্ন নেই।’’

Murder TMC Panchayat Chief Sukur Sheikh সুকুর শেখ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy