Advertisement
E-Paper

ক্ষোভের মাঝেই পরপর দেহ

একে একে আঠারোটা। এ পাড়ে কালনা খেয়াঘাটের আশপাশে মেলে ন’টা দেহ। বাকি ন’টা মেলে নদিয়ার নৃসিংহপুর ঘাটের কাছে।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০১:২৮
ভাগীরথীতে চলছে তল্লাশি। কালনায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

ভাগীরথীতে চলছে তল্লাশি। কালনায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

একে একে আঠারোটা। এ পাড়ে কালনা খেয়াঘাটের আশপাশে মেলে ন’টা দেহ। বাকি ন’টা মেলে নদিয়ার নৃসিংহপুর ঘাটের কাছে।

অনুমানের থেকে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে ক্ষোভ বাড়ে। সোমবার দিনভরই কখনও ঘাটে, কখনও হাসপাতালের মর্গে পুলিশ, প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়োতে দেখা যায় মৃতদের পরিজনেদের। তাঁদের দাবি, পুলিশ আরও সতর্ক হলে বিপদ এড়ানো যেতে পারত।

এর সঙ্গেই এ দিন ঘাট মালিকদের বিরুদ্ধে চুক্তি না মানার অভিযোগে থানায় এফআইআর করে কালনা পুরসভা। পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ বাগের দাবি, ইজারাদারেরা চুক্তি মানলে নৌকাডুবির মতো দুর্ঘটনা হতো না। যদিও ইজারাদারেরা মানতে চাননি।

শনিবার রাতে ভবা পাগলার উৎসব দেখে ফেরার পথে খেয়াঘাটে অত্যধিক ভিড়, বেলাগাম ভুটভুটিতে উঠে পড়ায় নৌকা উল্টে যায়। নৌকা ভেঙে ভাগীরথীতে তলিয়ে যান বহু মানুষ। কেউ কেউ সাঁতরে উঠে আসেন। অনেককে পুলিশ, মাঝি, স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধার করে। অভিযোগ ওঠে, পুলিশ থাকলেও লাইন করে নৌকায় ওঠানো বা ভিড় নিয়ন্ত্রণ কোনওটাই করতে পারেনি। যদিও পুলিশের দাবি, ক্রমাগত মাইকে ঘোষণা চলছিল। কিন্তু ভিড় ঠেলে জেটি পর্যন্ত পৌঁছনো যায়নি। এর সঙ্গেই ডুবুরি দেরি করে আসা, উদ্ধার কাজে গাফিলতির অভিযোগও ওঠে। ক্ষোভে ধুন্ধুমার হয় নদীর ও পাড়েও।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রবিবার সকাল ৮টা নাগাদ নিখোঁজদের দেহ উদ্ধারের জন্য নদিয়া থেকে দুই ডুবুরি আসেন। তবে কোনও দেহ মেলেনি। পরে আসানসোল থেকে আনা হয় সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের। দুপুর থেকে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম নিয়ে জলে নামেন জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা দলের (এনডিআরএফ) সদস্যরা। তাঁদের ৪৩ জন সদস্যের মধ্যে ৮ জন ছিলেন ‘ডিপ ড্রাইভার’, তাঁরাই জলে নেমে দেহ খোঁজার কাজ শুরু করে। তাতেও কাজ হয়নি। ডুবুরিদের দাবি, জলের অত্যাধিক চাপে এবং স্রোতে কোন জায়গায় দেহ রয়েছে ঠাহর করতে পারছিলেন না তাঁরা। রাত আটটা নাগাদ প্রথম একটি মৃতদেহ উদ্ধার হয় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। রাত বাড়লে আরও দেহ ভেসে ওঠে। উদ্ধারকারী দলের এক সদস্য একে চিদানন্দ জানান, নদীর গভীরতা ৪০ ফুটের বেশি। নদীর নীচে অত্যাধিক চাপে প্রথমে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছিল না। দেহগুলি ভেসে উঠতেই উদ্ধার কাজ শুরু হয়। ঘটনাস্থল থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে বেশির ভাগ দেহ মিলেছে বলেও তাঁদের দাবি। সোমবার সকালেও কালনা খেয়াঘাট লাগোয়া এলাকায় উদ্ধার হয় একটি দেহ। সারা দিন দফায় দফায় এনডিআরএফের কর্মীরা নদীতে স্পিড বোট চালিয়ে পাক খান। যদিও সন্ধ্যা পর্যন্ত আর কোনও মৃতদেহ উদ্ধার হয়নি। বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সদস্যদের পাশাপাশি নিখোঁজদের আত্মীয়েরাও নৌকা নিয়ে খুঁজতে শুরু করেন। নদিয়ার সাহেবডাঙা এলাকার প্রতাপ ঘোষ বলেন, ‘‘এক আত্মীয়ের খোঁজে সারা রাত নৌকা নিয়ে ঘুরেছি। তাঁকে না পেলেও সোমবার ভোরে অন্য চারটি দেহ নদী থেকে তুলেছি।’’ মৃতদের আত্মীয়দের অনেকেই ঘটনার দিনের পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের দাবি, ঘাটে যে বিপদ ঘটতে পারে তা আমল দিতে চায়নি পুলিশ। তাই সারাদিন তিন জন মাত্র পুলিশকর্মী রাখা হয়েছিল। শান্তিপুরের বাসিন্দা রমেন বিশ্বাসও জানান, ভিড়ের মধ্যে যাতে হুড়মুড়িয়ে নৌকায় লোক না ওঠে সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল পুলিশের। তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। যদিও জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অনেকেই নৌকায় ঠেলে উঠে পরেন। তাতেই নৌকা ভেঙে যায়।’’

কালনা মহকুমা হাসপাতালের মর্গে পরিজনদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। নদিয়ার হবিবপুর এলাকার বাসিন্দা শ্রীবাস ঘোষের (৪৫) দেহ উদ্ধারের সময় হাতে জড়ানো লাল রঙের একটি ব্যাগ পাওয়া যায়। সেই ব্যাগ হাতে নিয়ে তাঁর ভাইপো রাজু ঘোষ বলেন, ‘‘উৎসব এসে কাকা ভবা পাগলার একটা ছবি কিনেছিল। সঙ্গে ছিল পান, সুপুরি, খয়ের এবং চুনের আলাদা আলাদা কৌটৌ। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কাকা পাগলকে হাত ছাড়া করেননি।’’ মায়ের শ্রাদ্ধের কাজে যোগ দিতে নদিয়ার ধানতলা থেকে বাপের বাড়ি এসেছিলেন ৪০ বছরের সন্ধ্যা মণ্ডল। শ্রাদ্ধের কাজ মিটলেও আত্মীয় পরিজনের খাওয়ানোর পর্ব ছিল রবিবার। তার আগে শনিবার স্বামী আবুল মণ্ডল এবং বোন আরতি মাঝিকে নিয়ে ভবা পাগলার মন্দিরে এসেছিলেন সন্ধ্যাদেবী। তাঁর দাদা অমল মণ্ডল বলেন, ‘‘মেজো বোন আরতি আগের নৌকায় নৃসিংপুর ঘাটে চলে যায়। সেখানেই ছোট বোনের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। তারপর আর টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ভগ্নীপতি প্রানে বাঁচলেও বোনটা ফেরেনি।’’ শান্তিপুরের বাসিন্দা দিলীপ বিশ্বাস একাই এসেছিলেন উৎসবে। তিনিও বাড়ি ফেরেন নি। তাঁর ভাইপো বাবলু বিশ্বাস জানান, ‘‘কালনা মর্গে এসে জানতে পারি নৌকা থেকে নামতে পারেনি কাকা।’’

Boat tragedy Bodies
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy