Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

অঙ্ক তৃণমূলের পক্ষে, তবু নিশানায় বিজেপি

কার নিশানায় কে? কে কাকে বেশি ভয় পাচ্ছে? আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি বিজেপি-র উত্থানে রাজ্যের শাসকদল শঙ্কিত? সিপিএমই বা কতটা নিরাপদ? তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেন যতই বলুন, তারকা গায়কের গান শুনে এসে লোকে তাঁকেই ভোট দেবে, সেই নিশ্চিন্তি কিন্তু মোটেই তাঁদের প্রচারের ধরন-ধারণে দেখা যাচ্ছে না।

প্রচারে বাবুল সুপ্রিয়। ফাইল চিত্র।

প্রচারে বাবুল সুপ্রিয়। ফাইল চিত্র।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০১:০৭
Share: Save:

কার নিশানায় কে? কে কাকে বেশি ভয় পাচ্ছে?

আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি বিজেপি-র উত্থানে রাজ্যের শাসকদল শঙ্কিত? সিপিএমই বা কতটা নিরাপদ?

তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেন যতই বলুন, তারকা গায়কের গান শুনে এসে লোকে তাঁকেই ভোট দেবে, সেই নিশ্চিন্তি কিন্তু মোটেই তাঁদের প্রচারের ধরন-ধারণে দেখা যাচ্ছে না। বরং স্ট্রিট কর্নার থেকে বড় সভা, প্রতি ক্ষেত্রেই তৃণমূলের বক্তাদের আক্রমণের প্রধান নিশানা হচ্ছেন বাবুল তথা নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি। সিপিএম অবশ্য এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকেই প্রধান প্রতিপক্ষ বলে ঠাওরাচ্ছে। তা-ও মাঝে-মধ্যেই ‘সাম্প্রদায়িক দল’ আওড়াতে ভুলছে না।

কেন এই বিজেপি ভীতি?

হিসেব বলছে, গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিজেপি-র ভোট ছিল সাড়ে পাঁচ শতাংশের মতো। পরিবর্তনের বিধানসভা ভোটে বাম-তৃণমূল তীব্র মেরুকরণে তা চার শতাংশেরও নীচে নেমে যায়। লোকসভা ভোটে মাত্র দু’টি বিধানসভা এলাকা, আসানসোল উত্তর এবং কুলটিতে বিজেপি-র ভোট ছয় শতাংশের বেশি ছিল। রানিগঞ্জ, আসানসোল দক্ষিণ এবং বারবনিতে ছিল সাড়ে পাঁচের আশপাশে। অর্থাৎ, প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএম এবং তৃণমূলের সঙ্গে তুলনাই হয় না।

গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের বংশগোপাল চৌধুরী প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট পেয়েছিল প্রায় ৪২ শতাংশ। দু’বছর পরে এই কেন্দ্রের অধীন সাতটি বিধানসভা ভোটে বামেরা প্রায় আট শতাংশ ভোট হারায়, কংগ্রেস-তৃণমূল প্রায় ১০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিল। বামেদের থেকে আট শতাংশ, বাকি দু’শতাংশ তারা ছিনিয়ে নিয়েছিল বিজেপি-র কাছ থেকে। চারটি পুরসভার মধ্যে রানিগঞ্জ ও জামুড়িয়া এখনও বামেদের দখলে আছে বটে, আসানসোল ও কুলটি ইতিমধ্যে তৃণমূলের দখলে। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই কেন্দ্রের মধ্যে থাকা ১৩টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে ১০টিই পায় তৃণমূল। মাত্র তিনটি বাম। অঙ্কের হিসেব ধরলে দোলা সেনের হাসতে হাসতে জেতার কথা। তা সত্ত্বেও তৃণমূল বিজেপি-র ভূত দেখছে কেন?

কারণ চারটি। এক) কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নেই, বরং তারা কিছুটা হলেও ভোট কাটবে। সেই ভোট যোগের বদলে বিয়োগ হবে, প্রভাব পড়বে দ্বিগুণ। দুই) দেশ জুড়ে মোদী হাওয়া। তিন) বাবুল সুপ্রিয়র মতো তারকা প্রার্থী, যিনি শুধু সেলিব্রিটি হয়ে হুডখোলা জিপে বসে নেই, বরং তরুণ তুর্কীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন। চার) তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, যার নেপথ্যে আছে কয়লাঞ্চলে প্রভাব এবং আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের (এডিডিএ) কর্তৃত্ব। এই চারে মিলে বিজেপি বা নিদেনপক্ষে সিপিএমের চতুর্বর্গ লাভ হয়ে যেতে পারে বলে তৃণমূলের আশঙ্কা। তার ফলেই বিজেপি-র প্রতি অখণ্ড মনোযোগ এবং ধারাবাহিক আক্রমণ।

ইতিমধ্যে আসানসোলে এসে মোদী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারকা বাবুলকে টক্কর দিতে তিনি সঙ্গে এনেছিলেন ‘মহাগুরু’ মিঠুন চক্রবর্তীকেও। দলের বাকিরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। আক্রমণ অন্য মাত্রাও নিচ্ছে। বারাবণিতে প্রচারের সময়েই স্থানীয় তৃণমূল বিধায়কের বাড়ির সামনে বাবুলকে কালো পতাকা দেখানো হয়েছিল। এর পরে ডামরায় মদ্যপ অবস্থায় প্রচারের অভিযোগ পরে তোলা হয়। যদিও তদন্তের পরে প্রশাসন জানিয়ে দেয়, অভিযোগ ভিত্তিহীন। রানিগঞ্জের নতুন এগারায় প্রচারে বাধা দেওয়া বিজেপি-কে। এর পরেই বাবুলের বিরুদ্ধে পুলিশের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া এবং অস্ত্র আইনে অভিযোগ দায়ের হয়। যদিও নির্বাচন কমিশনের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে কিছুই ধরা পড়েনি।

তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ব্যাখ্যা, আগের অঙ্ক যা-ই বলুক রানিগঞ্জ-জামুড়িয়া আসানসোল-বরাকরের ব্যবসায়ী মহল এবং অবাঙালি ভোটারদের একটা বড় অংশ এ বার বিজেপি-র দিকে ঢলে যেতে পারেন। এর অনেকটাই বামবিরোধী ভোট, যা অন্যথায় তৃণমূলেরই পাওয়ার কথা। তা ছাড়া, দোলা যদি জেতেন সাংসদ হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এডি ডিএ-র চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। সেটা সম্ভবত জেলার নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশের পছন্দ হবে না। ফলে, তাঁরা কতটা গা ঘামাবেন তা নিয়েই দলেরই অনেকের সন্দেহ আছে। রাজ্যের মন্ত্রী তথা আসানসোলের ভোটের তৃণমূলের মূল কাণ্ডারী মলয় ঘটক অবশ্য দাবি করেন, “আমরা এ নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। ভোটের ময়দানে সবাই আমাদের প্রতিপক্ষ। ফলাফলে এক নম্বরে থাকছি, পরে কারা থাকবেন জানি না।”

ভয় পাচ্ছে সিপিএমও। পরিবর্তনের পরেও জামুড়িয়া-রানিগঞ্জে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছিল বামেরা। কিন্তু সেখানেও বিজেপি দাঁত ফোটাবে বলে নিচুতলার খবর। বংশগোপালের বক্তব্য, “রাজ্যে তৃণমূলই প্রধান প্রতিপক্ষ। গত ৩৪ মাসে রাজ্যের কোনও উন্নতি হয়নি। একাধিক দুর্নীতি হয়েছে। সে সব কথা আগে তুলতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আটকাতে বিজেপির বিরুদ্ধেও আমরা বলছি।” দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার মনে করছেন, “আমাদের বেশ ি কছু ভোট বিজেপি পাবে। তবে সেটা তুলনায় তৃণমূলের চেয়ে কম।” তবে তাঁর দাবি, “ভোট কাটাকাটিতে আমাদের অবস্থা ভাল।”

কী বলছে বিজেপি? কাকে প্রতিপক্ষ মনে করছে তারা? বিজেপি-র জেলা সভাপতি নির্মল কর্মকারের দাবি, “এই শিলাঞ্চলে এমনিতেই ১৭ শতাংশ ভোট রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থী না পাওয়ায় সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এ বার ভোট অনেক বাড়বে।” তাঁর মতে, “বাড়তি ভোট সিপিএম ও তৃণমূল, উভয়ের কাছ থেকেই আসবে। তবে, তুলনামূলক বেশি আসবে তৃণমূলের ঘর ভেঙে। যার বেশির ভাগটাই আবার নতুন প্রজন্মের ভোট।”

তাই কি এত তর্জন-গর্জন, অভিযোগ, পুলিশি লম্ফঝম্প? ভোটারই ভাল বুঝবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sushanta banik asansol babul
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE