Advertisement
E-Paper

অনিয়মের নার্সিংহোমে নাভিশ্বাস রোগীর

কখনও ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া আক্রান্ত যুবককে ‘এইচআইভি আক্রান্ত’ বলে রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া। কখনও আবার রসিদ চাওয়ার ‘অপরাধে’ রোগীকে আটকে রাখা। উন্নত চিকিৎসা পেতে গাঁটের কড়ি খরচ করে যেখানে যান মানুষ, বর্ধমান শহরে সেই সব নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ভুরি-ভুরি।

রানা সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৯
খোসবাগান এলাকায় গায়ে-গায়ে একাধিক নার্সিংহোম ও চিকিৎসকের চেম্বার। ছবি: উদিত সিংহ।

খোসবাগান এলাকায় গায়ে-গায়ে একাধিক নার্সিংহোম ও চিকিৎসকের চেম্বার। ছবি: উদিত সিংহ।

কখনও ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া আক্রান্ত যুবককে ‘এইচআইভি আক্রান্ত’ বলে রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া। কখনও আবার রসিদ চাওয়ার ‘অপরাধে’ রোগীকে আটকে রাখা। উন্নত চিকিৎসা পেতে গাঁটের কড়ি খরচ করে যেখানে যান মানুষ, বর্ধমান শহরে সেই সব নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ভুরি-ভুরি।

বর্ধমান শহরের খোসবাগান এলাকায় রয়েছে অসংখ্য চিকিৎসকের চেম্বার। সেগুলিতে সকাল থেকে লম্বা লাইন এলাকার চেনা ছবি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোম। সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর ঘাটতি নিয়ে তবু কথা হয়। কিন্তু অলি-গলিতে তৈরি হওয়া অনেক নামীদামী নার্সিংহোমে কার্যত প্রতারণা করা হয় বলে দাবি রোগী ও তাঁরা পরিজনদের। এই সব নার্সিংহোম নিয়ে অভিযোগেরও অন্ত নেই।

অভিযোগ ১: এই শহরের নার্সিংহোমগুলি ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট মেনে চলে না। এই আইন অনুযায়ী প্রতি নার্সিংহোমের বাইরে চিকিৎসক বা রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসারদের (আরএমও) নামের তালিকা টাঙাতে হবে। তাঁদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ডিগ্রিও ঝুলিয়ে দিতে হবে প্রকাশ্যে। অথচ, শহরের প্রায় কোনও নার্সিংহোমেই তা নেই। এ ছাড়া চিকিৎসকদের পরিষেবা ক্ষেত্র, অর্থাৎ তিনি কীসের বিশেষজ্ঞ, তাঁর ফি কত তা-ও প্রকাশ্যে টাঙানোর কথা। সে সবের বালাই প্রায় কোনও নার্সিংহোমেরই নেই। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের নামের তালিকাও।

অভিযোগ ২: প্রত্যেক নার্সিংহোমের কর্মীদের কর্তৃপক্ষের তরফে নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা। কিন্তু, কোথাও তা দেওয়া হয় না। ফলে কর্মীরা কার্যত ‘আয়ারাম গয়ারাম’।

অভিযোগ ৩: চিকিৎসা শেষে প্রত্যেক রোগীকে খরচের রসিদ দেওয়ার কথা। অথচ শহরের কোনও নার্সিংহোমেই তা দেওয়া হয় না। এমনকী সাধারণ মানুষ রসিদ চাইলে তাঁদের কাছ থেকে ১০-১৫ হাজার অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়। সম্প্রতি খোসবাগান এলাকার এক নার্সিংহোমে এক ব্যক্তির চিকিৎসার পরে খরচ হওয়া ৩৫ হাজার টাকার রসিদ চান আত্মীয়েরা। রসিদ দেওয়া নিয়ে গোলমালের জেরে রোগীকে প্রায় তিন দিন আটকে রাখা হয় নার্সিংহোমে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ওই রোগী ছাড়া পান।

অভিযোগ ৪: বর্ধমানের প্রায় সব ক’টি নার্সিংহোমেরই নিজস্ব প্যাথলজি সেন্টার রয়েছে। অনেক সময়েই রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই ল্যাবে তাঁদের রক্ত ও আরও নানা কিছু পরীক্ষা করানো হচ্ছে। রোগীর আত্মীয়েরা জানান, ওই কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসকের সই করা কাগজে অনায়াসে রিপোর্ট লিখে দিচ্ছেন একশ্রেণির কর্মীরা। এতে নানা গোলমালও হচ্ছে। কিছুদিন আগে এক যুবকের রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়া হয়, তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। পরে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে। কিন্তু ভুল রিপোর্টের জেরে ওই যুবকের বিয়ে ভেঙে যায়।

অভিযোগ ৫: নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগ অগুণতি। সম্প্রতি শহর লাগোয়া কৃষক পরিবারের এক সদস্য মাঠে কাজ করতে গিয়ে পায়ে কিছুর কামড় খান। শহরের এক নার্সিংহোমে আনা হলে তিনি বুকে যন্ত্রণার কথাও জানান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আইসিইউতে ঢুকিয়ে হৃদরোগের পরীক্ষা করানো হয়। শেষে যখন প্রমাণ হয় তাঁকে বিষাক্ত সাপে কামড়েছে, তড়িঘড়ি নার্সিহোম কর্তৃপক্ষ তাঁকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে। কলকাতার এক হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে প্রাণে বাঁচেন ওই ব্যক্তি। অথচ, আগেই যদি হাসপাতালে ঠিক মতো চিকিৎসা হতো, তাহলে প্রাণের ঝুঁকিও হত না, আবার খরচও কম হত বলে ওই ব্যক্তির পরিবারের দাবি।

অভিযোগ ৬: প্রসূতিদের উপযুক্ত দেখভালের অভাব রয়েছে। বিশেষত, রাতের দিকে যে সব প্রসব হয় তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করে চলে যাওয়ার পরে কোনও আরএমও থাকার কথা। অথচ আরএমও থাকুন বা না থাকুন নিয়মমাফিক আধঘণ্টা অন্তর রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয় না। ফলে রক্তচাপ নেমে অনেক প্রসূতিই অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। সাধারণ মানুষের দাবি, উপযুক্ত দেখভাল হলে শহরে প্রসূতি মৃত্যু আরও নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত।

অভিযোগ ৭: এছাড়া রাত বাড়লেই ভর্তি নিতে না চাওয়া, সামান্য জ্বর-জ্বালাতেই হাসপাতালে ঠেলে দেওয়াএ সবের অভিযোগ তো রয়েইছে। রোগীর পরিবারের দাবি, নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ সাফ বলেন, ‘হাসপাতাল চেনেন তো? সেখানেই নিয়ে যান। আমরা রাতে ঝামেলা চাই না।’

শহরের নার্সিংহোমগুলিতে গত পাঁচ বছরে চিকিৎসায় গাফিলতিতে প্রায় ৬০ জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে বলে জানান জেলা ক্রেতা সুরক্ষা ও কল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদক কুদরাতুল আবেদিন। তিনি বলেন, “প্রতিটি ঘটনার পরে গোলমাল হয় নার্সিংহোমে। চলে ভাঙচুর, কর্মী ও চিকিৎসকদের মারধর। আমরা মানুষকে সংযত হতে বলেছি। বলছি, আইনি রাস্তায় হেঁটে নিজের পরিজনের মৃত্যুর সুবিচার নিন।”

নার্সিংহোমগুলি যে ক্রমেই গলার কাঁটা হয়ে উঠছে তা কবুল করেছেন বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণবকুমার রায়। তিনি বলেন, “প্রায় ১৫-২০টি নার্সিংহোম ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। মূলত চার ধরনের বেআইনি কাজের প্রমাণ মিলেছে। যেমন, যত শয্যা দেখিয়ে লাইসেন্স নেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি করানো হয়। নার্সিংহোমে আরএমও নেই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স নেই। উপরে যত চাকচিক্য, পরিষেবার দিক দিয়ে ততটাই দৈন্যদশা তাদের। কয়েকটিতে পরিষেবা দেওয়ার নামে বিশাল অঙ্কের বিল ধরানোর অভিযোগও আমরা পেয়েছি।” কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর যত নার্সিংহোম বন্ধ করে দিয়েছিল সেগুলির প্রায় সবকটিই খুলে গিয়েছে বলে জানালেন ডেপুটি সিএমওএইচ-১ নির্মাল্য রায়। তিনি বলেন, “চাপে পড়ে ওই নার্সিংহোম বা প্যাথলজিক্যাল কেন্দ্রগুলি দরকারি কাগজপত্র জমা দিয়েছে। তবে আমাদের একটি টাস্ক ফোর্স রয়েছে। তাতে রয়েছেন পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের লোকেরা। মাঝেমধ্যেই রুটিন তদন্ত করা হয়।”

যদিও জেলা ‘নার্সিংহোম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক রঞ্জন ঘোষের দাবি, “আমরা প্রত্যেকে ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট মেনে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত নার্সদের নিয়ে। কারণ তাঁদের সংখ্যা অপ্রতুল। জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি প্রয়োজনে কিছু মেয়েকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তাহলে আমরাও বেঁচে যাই।”

(চলবে)

amar shohor nursing home rana sengupta bardwaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy