কালনার একটি মণ্ডপে তোলা নিজস্ব চিত্র।
এক দশক আগেও দুর্গাপুজোর যাবতীয় জৌলুস ছিল বনেদি বাড়ি ঘিরে। বরং সরস্বতী পুজো ছিল মহকুমার সাধারণ মানুষের সর্বজনীন উৎসব। তবে এখন ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। জমিদারির পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতা বা অন্য বড় শহরে স্থায়ী ঠিকানা গড়েছেন অনেকে। আবার টাকাপয়সার টানাটানিতে জৌলুস কমিয়ে নিয়মরক্ষায় পুজো সারছেন বহু লোক। সে জায়গায় এগিয়ে এসেছে বারোয়ারি পুজো। মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কালনা মহকুমায় ১২৫টিরও বেশি পুজো কমিটি পুজোর অনুমতি নিয়েছে এ বার।
কয়েক বছর আগেও মহাষষ্ঠীর দিন বনেদি বাড়ির আটচালা থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ জানান দিত, পুজো এসে গিয়েছে। গ্রামে গ্রামে বনেদি বাড়ির পুজোর পাত পড়ত অসংখ্য মানুষের। প্রতিমা সাজাতে আশপাশের গ্রাম, জেলা থেকে আসতেন শিল্পীরা। আটচালায় হালকা হিমে রাত জেগে যাত্রা দেখত গ্রাম। কেউ গরিবদের জামাকাপড় দিতেন, কোথাও আবার সন্ধি পুজো দেখতে একজোট হতেন গ্রামবাসী। তবে এখন সেই রমারমা, জৌলুস অনেকটাই ফিকে। কালনার আশপাশের গ্রাম থেকে বহু বনেদি বাড়ি বাস উঠিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে গত দশ বছরে। যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও পুজোর পুজো সীমিত করে ফেলেছেন পরিবারিক গণ্ডীতে। কালনা ১ ব্লকের সুলতানপুর পঞ্চায়েতের উপলতি গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের পুজোয় একসময় তাঁদের শিষ্য বৈদ্যপুরের অভিজাত পরিবার নন্দি বাড়ির তরফে প্রচুর উপঢৌকন আসত। এখন সে সবের কিছুই মেলে না। অর্থাভাবে ধুঁকছে পাটুলির ভট্টাচার্য পরিবার, কালনার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মতো বহু পুজোও।
তাই বোধহয় বাড়ির ঠাকুরদালান ছেড়ে বারোয়ারি পুজোয় ঝুঁকছেন মানুষ। মহকুমা প্রশাসনের হিসেবেও, এতগুলি ক্লাব ও বারোয়ারি দুর্গাপুজোর অনুমতি এ শহরে আগে নেয়নি। সর্বজনীন দুর্গোৎসব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে থিমের প্রতিযোগিতাও। উদ্বোধনে, মণ্ডপে, প্রতিমায় একে অপরকে টেক্কা দিতে এক পুজো পেরোতে না পেরোতেই পরের বারের থিম ভাবতে শুরু করে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ব্যালে নাচ থেকে বাউল গান সবেরই আয়োজন রয়েছে এ বছর। চতুর্থী থেকেই পুজোর উদ্বোধন শুরু হয়ে গিয়েছে। শহরের আদি সব্যসাচী ক্লাবের উদ্বোধনে এসেছেন সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রাণী সেন। এসটিকেকে রোডের পাশে বিশাল মণ্ডর বেঁধেছে গোয়াড়া সর্বজনীন। হালকা সবুজ রঙের মণ্ডপের বাইরেও রয়েছে বেশ কিছু পৌরাণিক মূর্তি। একটু দূরের নিভুজি বাজার বারোয়ারিও যেন পাল্লা দিয়ে বড় মণ্ডপ গড়েছে। অনেক ক্লাব মণ্ডপের পাশের মাঠে মেলার আয়োজন করেছে। লক্ষ্মণপাড়ার সব্যসাচী ক্লাবও জনপ্রিয় বাংলা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের দুই সঙ্গীতশিল্পীকে আনছে। পিছিয়ে নেই পূর্বস্থলীর ক্লাবগুলিও। দক্ষিণ শ্রীরামপুরের আমরা ক’জনের মণ্ডপে দর্শকরা পাবেন মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের স্বাদ। নসরতপুর পঞ্চায়েত এলাকার ২৮টি ক্লাব এ বার একাদশীর দিন আতসবাজি প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান রেখেছে। পাটুলির একটি ক্লাব তাদের থিমে রেখেছে এলাকার বিভিন্ন দেবদেবীর ইতিহাস। মন্তেশ্বরের একতা সঙ্ঘের প্রতিমা শান্তির প্রতীক। অসুরও অস্ত্রহীন। সুভাষ স্মৃতি সঙ্ঘ রাজ্য জুড়ে চলা নারীদের উপর নির্যাতনকেই থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
মহকুমা প্রশাসনের তরফেও নির্বিঘ্নে পুজো সারতে আগে থেকেই নানা উদ্যোগ করা হয়েছে। পুজোর আগে বৈঠক করে ‘এক-জানালা’ পদ্ধতি চালু করে ক্লাবগুলিকে এক ছাদের তলায় বিভিন্ন দফতর থেকে পুজোর অনুমতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কালনা থানা উদ্বোধন করেছে পুজোর গাইড ম্যাপ। খবরের কাগজের সঙ্গে শহরবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে তা। শিশুদির জন্য বিশেষ পরিচয়পচত্র চালু করা হয়েছে। কালনার মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ইন্দ্রজিৎ সরকার জানান, দর্শনার্থীদের ঠাকুর দেখতে যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্য রাস্তায় পুলিশ যাবতীয় সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy