বন্ধ পড়ে দুর্গাপুরের জেসপ কারখানা। বিশ্বনাথ মশান।
আবির খেলা, মিষ্টিমুখে মেতেছে শিল্পাঞ্চলেরই একটি দিক। অন্য দিকে তখনও গাঢ় অন্ধকার।
রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেব্লস কারখানা নিয়ে যখন আশার কথা শোনা যাচ্ছে, দুর্গাপুরের এমএএমসি, এইচএফসিল থেকে বিওজিএলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলি নিয়ে এখনও কোনও দিশা নেই।
দুর্গাপুরে যে বছর প্রথম মাল্টিপ্লেক্স চালু হল, তার পরের বছরই পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে গেল বিওজিএল। সেটা ২০০৭ সাল। তারও বছর ছয়েক আগে ঝাঁপ পড়েছে এমএএমসি-তে। ১৯৯৮ সাল থেকে উত্পাদন বন্ধ এইচএফসিএলে। দুর্গাপুরে শুধু এই তিনটি সংস্থা মিলিয়েই কাজ হারিয়েছেন প্রায় দশ হাজার স্থায়ী কর্মী। ২০০৬ সালে যখন আসানসোলের রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানা ইস্কোর জন্য আবার দশ হাজার কোটি টাকার আধুনিকীকরণ প্রকল্পের শিলান্যাস করে যাচ্ছেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, দুর্গাপুরের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলি তখন রীতিমতো ধুঁকছে। কয়েক বছর টালবাহানার পরেও দুর্গাপুরের এমএএমসি কবে খুলবে তা অনিশ্চিত।
শুরুর দিকে দুর্গাপুর শহর ছিল বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প নির্ভর। ডিএসপি, এএসপি, এমএএমসি, এইচএফসিএল, বিওজিএলবহু মানুষ কাজ করতেন এই কারখানাগুলিতে। সংস্থার নিজস্ব টাউনশিপ ছিল। পরিস্থিতির বদল শুরু হয় আটের দশকে। নানা কারণে এই কারখানাগুলি রুগ্ণ হয়ে পড়ে। নয়ের দশকের মাঝামাঝি ডিএসপি-তে বড়সড় আধুনিকীকরণে উদ্যোগী হয় কেন্দ্র। তার সুফল পায় এএসপিও। কিন্তু বাকিগুলি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
এমএএমসি কারখানা।
এইচএফসিএল কারখানা।
খনির যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য ১৯৬৫ সালে চালু হওয়া এমএএমসি ১৯৯২ সালে চলে যায় বিআইএফআর-এ। ২০১০ সালে তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিইএমএল, সিআইএল এবং ডিভিসি কনসর্টিয়াম গড়ে কলকাতা হাইকোর্টে নিলামে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকা দর দিয়ে এমএএমসি-র দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তার পরে চার বছর পেরিয়ে গেলেও এমএএমসি খোলেনি। জানা গিয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা বিইএমএল এখনও মন্ত্রকের ছাড়পত্র পায়নি।
এইচএফসিএল ইউরিয়া সার উত্পাদন শুরু করে ১৯৭৪ সালে। নব্বই দশকের গোড়া থেকে লোকসান শুরু। ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট কারখানাটি খুলতে সবুজ সঙ্কেত দেয়। ২০০৯ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা কারখানা অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তারা পানাগড় শিল্পতালুকে নিজস্ব সার কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিওজিএল খোলার সব সম্ভাবনা কার্যত শেষ। ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা এই কারখানায় চশমার বাইফোকাল লেন্স, সামরিক বিভাগের অপটিক্যাল লেন্স, ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে ব্যবহৃত ফিল্টার গ্লাস ইত্যাদি তৈরি হত। ১৯৯২ সালে সেটি চলে যায় বিআইএফআরের অধীনে। ২০০৩ থেকে উত্পাদন বন্ধ। দুষ্কৃতীরা সমস্ত যন্ত্রাংশ চুরি করে চত্বর ফাঁকা করে দিয়েছে।
গত তিন-চার বছরে কয়লার চোরা কারবারে লাগাম, বহু বেসরকারি মাঝারি কারখানায় উত্পাদন বন্ধ এবং সারদা-কাণ্ডের পরে লগ্নি সংস্থাগুলির গুটিয়ে যাওয়ার প্রভাব দুর্গাপুরের অর্থনীতিতে পড়েছে বলে মনে করে বণিক মহল ও নাগরিকদের একাংশ। হাল ফেরাতে যে বড় শিল্পের প্রয়োজন বলে তাঁদের দাবি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বৃহত্ লগ্নি নিয়ে এগিয়ে আসছেন না কোনও শিল্পপতি। এক সময়ে শিক্ষা ছিল এই শহরে বিনিয়োগের অন্যতম লাভজনক ক্ষেত্র। কিন্তু গত দু’তিন বছরে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজেও পড়ুয়ার আকাল দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে নতুন লগ্নির ঝুঁকি আর নিচ্ছেন না কেউ।
তুলনায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ এখন অনেকেরই পাখির চোখ। বেসরকারি উদ্যোগে শহর ও লাগোয়া এলাকায় দু’টি মেডিক্যাল কলেজ চালুর প্রক্রিয়া চলছে। বিধাননগরের একটি মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্ডালে নির্মীয়মাণ বিমাননগরীতে নতুন হাসপাতাল গড়ার জন্য জমি কিনে রেখেছেন। সিটি সেন্টারে তাঁরা সম্প্রতি একটি সর্বক্ষণের ক্লিনিক চালু করেছেন। একই পথে হেঁটেছে আরও এক সংস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পোদ্যোগী বলেন, “মানুষ সর্বাধিক গুরুত্ব দেন এমন একটি ক্ষেত্র হল স্বাস্থ্য। তা ছাড়া রাজ্যে বর্তমানে চিকিত্সকের আকাল রয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই হাসপাতাল ও চিকিত্সকের চাহিদাও বাড়বে।”
কিন্তু নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশের ধারণা, দুর্গাপুরে আগের স্বচ্ছল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই আরও বড় উদ্যোগ। সে ক্ষেত্রে তুরুপের তাস হতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলির পুনরুজ্জীবনই, মনে করছেন তাঁরা।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy