Advertisement
E-Paper

এক চিকিত্‌সকের ভরসায় গোটা শহর

পঞ্চাশ হাজার মানুষের সম্বল একটাই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চার বছর ধরে গুসকরার অভ্যেস এটাই। হাসপাতালের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইন দাঁড়ানো, শয্যা না পাওয়া, সিজার করতে হলেই ছুটোছুটি পড়ে যাওয়া—রোজনামচা হয়ে গিয়েছে এ শহরের। বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছেন, অসুস্থ হলেই পাশের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছোটা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আর শুধু এ শহর নয়, আশপাশের আরও খান কুড়ি গ্রামেরও হাল একই।

রানা সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৫
পরিষেবা না পেয়ে ভিড় কমেছে রোগীদের। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই দরজা-জানালা বন্ধ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। ছবি: উদিত সিংহ।

পরিষেবা না পেয়ে ভিড় কমেছে রোগীদের। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই দরজা-জানালা বন্ধ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। ছবি: উদিত সিংহ।

পঞ্চাশ হাজার মানুষের সম্বল একটাই স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

চার বছর ধরে গুসকরার অভ্যেস এটাই। হাসপাতালের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইন দাঁড়ানো, শয্যা না পাওয়া, সিজার করতে হলেই ছুটোছুটি পড়ে যাওয়া—রোজনামচা হয়ে গিয়েছে এ শহরের। বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছেন, অসুস্থ হলেই পাশের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছোটা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আর শুধু এ শহর নয়, আশপাশের আরও খান কুড়ি গ্রামেরও হাল একই।

সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে এ শহরে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানেও আছেন চিকিত্‌সক একজন, তাও হোমিওপ্যাথি। নার্স, সাফাইকর্মী অপ্রতুল। মেডিক্যাল অফিসারের তো দেখা মেলেনি গত চার বছর ধরে। অথচ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রর পাশে অন্তত ১০ বিঘে জমি পড়ে রয়েছে। ১০০ শয্যার হাসপাতাল গড়ার দাবিও বহুদিনের। কিন্তু বাসিন্দাদের সেই দাবি তো পূরণ হয় নি। উল্টে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। বাসিন্দাদের অভিযোগ, শাসক ও বিরোধী দলের কোন্দলে পিছিয়ে পড়েছে শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা। তবে সেদিকে নজর নেই কোনও দলেরই। তাঁদের আরও প্রশ্ন একজন হোমিওপ্যাথ চিকিত্‌সকের পক্ষে শহরের প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাসিন্দার দেখভাল সম্ভব কীভাবে?

দুর্দশার কথা মেনে নিয়েছেন গুসকরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত চিকিত্‌সক পি কে নস্করও। তিনি জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে ছ’জনের জায়গায় তিন জন নার্স রয়েছেন, সাফাইকর্মীও রয়েছেনন এক জন। ওই চিকিত্‌সক বলেন, “এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি শয্যা রয়েছে। তার পাঁচটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু মহিলাদের স্বাভাবিক প্রসব ছাড়া কিছুই হয় না সেখানে। সিজারের পরিস্থিতি এলেই ওই প্রসূতীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।” আরও জানা গিয়েছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ জনের বেশি প্রসূতী চলে এলে তাঁদের লেবার রুমের মেঝেতে শুয়ে অপেক্ষা করতে হয়, এমনকী অনেক সময় পুরুষদের শয্যাতেও তাঁদের রাখা হয়। এছাড়া ওই হাসপাতালে প্রায় ৪ বছর ধরে কোনও মেডিক্যাল অফিসার নেই, নার্সিং স্টাফের ঘাটতিও রয়েছে বছর দেড়েক ধরে। এমনকী যে তিনজন নার্স রয়েছেন তাঁরাও নিয়মিত আসেন না বলে অভিযোগ ওই চিকিত্‌সকের। স্থানীয় উক্তা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আসা মিতা উপাধ্যায়ের উপর রয়েছে মহিলাদের প্রসবের দায়িত্ব। রোগীদের একাংশ জানান, মিতাদেবী আর নস্কর ডাক্তারের উপর ভর করে কোনওমতে বন্ধ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে রয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি।

স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দৈন্য দশায় বিরক্ত স্থানীয় লোকজনও। বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা উমাশঙ্কর পালের দাবি, “নামেই এটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। না আছে ওষুধ, না আছে ডাক্তার। সামান্য ফোঁড়া কাটাতেও ছুটতে হয় বর্ধমান।” পুরসভা পাড়ার আর এক বাসিন্দা প্রশান্ত দাসের আবার অভিযোগ, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার যে ওষুধ লিখে দেন তার দাম প্রচুর। সব জায়গায় মেলেও না। ওখানে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান হলে সুবিধা হয়।”

কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে ১০০ শয্যার স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পরিণত করার দাবিতে তীব্র আন্দোলেনে নেমেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সিপিএমের গুসকরা জোনাল কমিটির সম্পাদক অচিন্ত্য মজুমদার বলেন, “২০০৮-০৯ সালে স্বাস্থ্য দফতরের কাছ থেকে ১০০ শয্যার হাসপাতালের অনুমোদন মিলেছিল। কিন্তু যেহেতু আউশগ্রামের বননবগ্রামে একটি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে তাই গুসকরার হাসপাতালটি হবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ঠিক হয়েছিল, আউশগ্রামের সরগ্রামে হাসপাতাল স্থানন্তর করা হবে। এলাকার মানুষও তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু বিরোধীদের বাধায় হয় নি।” অচিন্ত্যবাবুর আরও দাবি, “হাসপাতাল স্থানান্তরের বিতর্কে আমাদের উপর আক্রমণও নেমে এসেছিল। এমনকী তত্‌কালীন জেলা সভাধিপতি উদয় সরকার গুসকরা হাসপাতালের শিল্যান্যাস করতে এসেও বিরোধাদের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ওই পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে চলে যায়।”

আর তৃণমূলের দাবি স্বাভাবিক ভাবেই এর উল্টো। গুসকরার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান চঞ্চল গড়াই বলেন, “তখন সামনে পুরভোট। সিপিএম ভোটের আশায় প্রচার করেছিল গুসকরাতেই ১০০ শয্যার হাসপাতাল হবে। কিন্তু বাস্তবে ওই ধরনের কোনও প্রকল্প গৃহীত হয়নি। কেবল মাত্র কয়েকটা ভবনের সংস্কার করার কথা ছিল।” তাঁর দাবি, “আমরা ক্ষমতায় আসার পরে ওখানে আধুনিক হাসপাতাল তৈরি করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত ভাবে আবেদন জানিয়েছি।” চঞ্চালবাবুর দাবি, ওই হাসপাতাল হলে শুধু গুসকরার চারপাশের গ্রামই নয়, মঙ্গলকোট, ভাতার, বীরভূমের বড় অংশের মানুষেরও উপকার হবে। কারণ তাঁদেরও গুসকরা হয়েই বর্ধমান নিয়ে যাওয়া হয়। পুরপ্রধান বুর্ধেন্দু রায় বলেন, “গুসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আধুনিকীকরণের জন্য অনেকেই আমাদের কাছে দাবি জানাচ্ছেন। বেহাল চিকিত্‌সা ব্যবস্থা নিয়ে প্রায়ই গোলমালেরও খবর পাই। মানুষের ক্ষোভে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝেমধ্যেই তালাও পড়ে যায়। আমাদের ছুটতে হয় পরিস্থিতি সামলাতে। ফলে ওখানে আধুনিক হাসপাতাল খুবই দরকার।”

বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায়ের আশ্বাস, “আমাদের অনেক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিত্‌সক, নার্সদের অভাব রয়েছে। তবে এ সপ্তাহে গুসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক জন মেডিক্যাল অফিসারের নিয়োগের অর্ডার হয়েছে। আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যেই ওই অফিসার যোগ দেবেন। তবে ওখানে ১০০ শয্যার হাসপাতাল গড়ার কোনও প্রস্তাব রয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।”

(চলবে)

amar shohor guskora rana sengupta health centre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy