Advertisement
E-Paper

জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের শিকার আরও অনেকেই

ভদ্রেশ্বরের মতো কারখানা আধিকারিককে প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনা এখনও ঘটেনি। তবে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও শ্রমিক অসন্তোষের মাত্রা কখনও-কখনও মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বহু কারখানায় দিনের পর দিন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শো-রুমের ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। কর্মী ও আধিকারিকরা নিগৃহীত হচ্ছেন। মুখ ফেরাচ্ছে নতুন লগ্নির সম্ভাবনা। পেটে টান পড়ছে শ্রমিকদের।

সুশান্ত বণিক ও সুব্রত সীট

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০১:২৯
মাঝেমধ্যেই হয় উৎপাদন বন্ধ করে আন্দোলন। —ফাইল চিত্র।

মাঝেমধ্যেই হয় উৎপাদন বন্ধ করে আন্দোলন। —ফাইল চিত্র।

ভদ্রেশ্বরের মতো কারখানা আধিকারিককে প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনা এখনও ঘটেনি। তবে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও শ্রমিক অসন্তোষের মাত্রা কখনও-কখনও মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বহু কারখানায় দিনের পর দিন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শো-রুমের ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। কর্মী ও আধিকারিকরা নিগৃহীত হচ্ছেন। মুখ ফেরাচ্ছে নতুন লগ্নির সম্ভাবনা। পেটে টান পড়ছে শ্রমিকদের।

সোমবার হুগলির ভদ্রেশ্বরে জুট মিলের আধিকারিককে হত্যা করার ঘটনায় শঙ্কিত আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের শিল্পমহল। শিল্পাঞ্চলের একাধিক বণিক সংগঠন ইতিমধ্যেই এই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছে, এই ধরনের জঙ্গি আন্দোলনের প্রবণতা রোধেরও দাবি জানিয়েছে। একাধিক কর্মসূচির কথাও ভাবা হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের ৯টি জেলার শিল্পপতিদের যৌথ সংগঠন ‘ফেডারেশন অব সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর সাধারণ সম্পাদক রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতানের অভিযোগ, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও প্রায় প্রতিদিনই জঙ্গিপনার শিকার হচ্ছে শিল্প। মনে হচ্ছে ছয়ের দশকের শেষ দিকের বছরগুলি ফিরে আসছে। সব ঘটনা অবশ্য প্রকাশ্যে আসে না। তাঁর কথায়, “আমাদের একটি প্রতিনিধি দল সোমবারই কলকাতায় রাজ্য সরকার আয়োজিত ‘কোর ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর সভায় মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর কাছে মৌখিক ভাবে নিজেদের চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেছে।”

বণিক সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক বছরে আসানসোলে অন্তত পাঁচটি সংস্থা জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের জেরে বেকায়দায় পড়েছে। এক বছর ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে একটি বিস্কুট কারখানা। সেই সংস্থার মালিক প্রেম গোয়েল বলেন, “ভদ্রেশ্বরে যা হয়েছে, তা মর্মান্তিক। কিন্তু আমার সঙ্গেও কম কিছু ঘটেনি। এই জঙ্গিপনার জন্যই এখানে শিল্প আসছে না। কী করে রাজ্যের উন্নতি হবে? অপরাধীরা সাজা না পেলে তো ওরা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে!” আসানসোল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সুব্রত দত্তও জানান, শ্রমিক সংগঠনগুলির অনমনীয় মনোভাবের জন্যই মাস পাঁচেক আগে হঠাৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় একটি বিস্কুট কারখানায়। চেম্বারের হস্তক্ষেপে সমস্যা আপাতত মিটেছে।

চেম্বার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, আসানসোলের একটি মিথেন গ্যাস উত্তোলক সংস্থায় মাঝে-মধ্যেই পরিবহণ কর্মীরা বিক্ষোভ দেখানোয় জটিল অবস্থা তৈরি হয়। বরাকরের একটি রিফ্যাক্ট্রি সংস্থার মালিক বছর খানেক আগে ব্যবসা গুটিয়েছেন। জামুড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি অজয় খেতান জানান, সেখানকার শিল্পতালুকগুলিতেও জঙ্গীপনা অব্যাহত। তিনি বলেন, “শুধু শ্রমিক সংগঠন নয়। দুষ্কৃতীরা ব্যক্তিগত আক্রোশে এমন ঘটিয়েছে। দাবি করছি, ভদ্রেশ্বরের অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক।” চেম্বার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, সাত মাস আগে এখানকার একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় ম্যানেজারকে মারধোর করা হয়। কিন্তু ঝামেলার আশঙ্কায় সংস্থার তরফে থানায় অভিযোগ জানানো হয়নি।

দুর্গাপুরেও গত কয়েক বছরে বারবার গা-জোয়ারির ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন আইএনটিটিইউসি নেতা তথা দুর্গাপুর ৩ নম্বর ব্লক তৃণমূল যুব সভাপতি অসীম প্রামাণিক জয় বালাজি কারখানায় আধিকারিকদের উপরে চড়াও হন বলে অভিযোগ। সেই রাতেই কারখানার এক আধিকারিক বিধাননগরে নিজের বাড়িতে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতীদের হাতে মার খান। ফের এমন ঘটলে কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার হুমকি দেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এর পরেও ওই নেতার বিরুদ্ধে একাধিক কারখানায় হাঙ্গামার অভিযোগ ওঠে। বিধাননগরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে বিতর্কে বাড়ান অসীমবাবু। চাপে পড়ে আইএনটিটিইউসি-র জেলা নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, ওই নেতা তাঁদের কেউ নন। পরে তাঁকে তৃণমূল থেকেও বহিষ্কার করা হয়।

কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত তো শুধু একটিই নয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে কাঁকসা থানার জাটগোড়িয়ায় তৃণমূলের নেতৃত্বে এসার অয়েলের প্রকল্পে যাওয়ার রাস্তা বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেন বাসিন্দারা। বাধা দেওয়া হয় কর্মীদের। তিন দিন সেখানে কাজ বন্ধ থাকে। ১১ অগস্ট ফের কাঁকসার আকন্দারায় বেশ কয়েক ঘণ্টা এসারের কাজ বন্ধ রাখা হয়। ২০ ডিসেম্বর দ্য মিশন হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেরির অভিযোগে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন, ভাঙচুরের হুমকিও দেন ডিপিএলের আইএনটিটিইউসি নেতা দেবদাস মজুমদার। গত ১২ জুন নানা দাবি-দাওয়ায় আইএনটিটিইউসি-র ঝান্ডা টাঙিয়ে ভিড়িঙ্গিতে একটি গাড়ি সংস্থার শো-রুম বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন শিল্প কারখানার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এর বাইরেও বহু ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতির চাপে সে সব চাপা দিয়ে রাখতে হয়।

শ্রমিক নেতারাও এই পরিস্থিতির কথা অস্বীকার করছেন না। কিন্তু তা বলে কেউ নিজের ঘাড়ে দায়ও কেউ নিতে রাজি নন। সিপিএম প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন সিটুর বর্ধমান জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্র কিশোর চক্রবর্তী বলেন, “রাজ্যে আইন শৃঙ্খলার বালাই নেই। ভদ্রেশ্বরের ঘটনা ফের তা প্রকাশ্যে এনে দিল। এমনিতেই রাজ্যে শিল্প গড়ে ওঠার কোনও খবর নেই। সোমবারের ঘটনা রাজ্যকে আরও পিছিয়ে দেবে।” প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তথা সিটু নেতা বংশগোপাল চৌধুরীও বলেন, “নৈরাজ্য আটকাতে না পারলে শিল্প গুটিয়ে যাবে। বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য গড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতেও প্রভাব পড়বে।”

প্রায় একই সুরে বিজেপি প্রভাবিত বিএমএস নেতা রামইলিশ রায় বলেন, “এমনিতেই এই রাজ্যে শিল্প আসা বন্ধ হয়েছে। এর পরে এ সব ঘটলে রাজ্যটাই তো পন্ড হয়ে যাবে।” কংগ্রেস প্রভাবিত আইএনটিইউসি নেতা অনিল ধর বলেন, “এই বার্তা ভাল নয়। রাজ্য প্রশাসন নিষ্ক্রিয়।” রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল প্রভাবিত আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ও কোনও জঙ্গিপনার দায় নিতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “আমরা শিল্পে যে কোনও রকম জঙ্গি আন্দোলনের বিরুদ্ধে। যারা এই নীতি মানে না তারা আইএনটিটিইউসি-র কেউ নয়।”

শুধু দায় অস্বীকার আর দোষ চাপানো দিয়ে দিয়ে যে শিল্পপতিদের আস্থা অর্জন করা যায় না, তা বোধহয় এ বার বোঝার সময় এসেছে।

subrata shit sushanta banik durgapur-asansol industrial park worker agitation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy