Advertisement
E-Paper

প্রতিরোধই হাতিয়ার নতুন জেলা সম্পাদকের

হাঁটি-হাঁটি পা-পা... দু’বছরের নাতির আঙুল ধরে হাঁটাচ্ছেন তিনি। একের পর এক ফোন আসছে। কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কেউ নেহাতই কেজো কথা বলছেন। রবিবার বার্নপুরে শেষ হওয়া জেলা সম্মেলনে জেলা সিপিএমও তাঁর আঙুল ধরেছে যে! প্রায় দেড় দশক জেলা সম্পাদক থাকার পরে খণ্ডঘোষের অমল হালদারকে সরিয়ে কাটোয়ার অচিন্ত্য মল্লিককে তাঁর কুর্সিতে বসিয়েছে সিপিএম।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৮

হাঁটি-হাঁটি পা-পা... দু’বছরের নাতির আঙুল ধরে হাঁটাচ্ছেন তিনি।

একের পর এক ফোন আসছে। কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কেউ নেহাতই কেজো কথা বলছেন। রবিবার বার্নপুরে শেষ হওয়া জেলা সম্মেলনে জেলা সিপিএমও তাঁর আঙুল ধরেছে যে!

প্রায় দেড় দশক জেলা সম্পাদক থাকার পরে খণ্ডঘোষের অমল হালদারকে সরিয়ে কাটোয়ার অচিন্ত্য মল্লিককে তাঁর কুর্সিতে বসিয়েছে সিপিএম। কিন্তু অমল-যুগের সুখের দিন বছর চারেক আগেই বিগত। শুধু রাজ্যে ক্ষমতা হারানো নয়, বর্ধমান পুরভোট থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচন সময় যত গড়িয়েছে, ততই দুর্বল হয়েছে গণভিত্তি। সেই ফাঁক দিয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপি। সোমবার দলের কাটোয়া জোনাল অফিসে বসে অচিন্ত্যবাবু তাই গোড়াতেই বলে দেন, “বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে জটিলতা ও প্রতিকূলতা রয়েছে।”

সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অচিন্ত্যবাবু বিলক্ষণ জানেন, তাঁর চলার পথে কতটা কাঁটা ছড়ানো। এক সময়ে যে বর্ধমান সিপিএমের আঁতুড় বলে গণ্য হত, সেখানে পরিস্থিতি এতটাই তলানিতে এসে ঠেকেছে যে সাংগঠনিক স্তরে যে কোনও ভুল তাঁদের আরও বেশি খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম যেখানে ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, দু’বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনে তা কমে ৪১ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৩-য় বর্ধমান পুরভোটে লড়তে নেমেও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে প্রার্থী তুলে নিয়েছিল সিপিএম। গত বছর লোকসভা নির্বাচনে তাদের ভোট গিয়ে ঠেকেছে ৩০ শতাংশে। জেলার তিনটি লোকসভা আসনই হাতছাড়া হয়েছে তাদের।

এই ধস থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে অচিন্ত্যবাবুকেই। দলের অন্দরের খবর, প্রথম দিন থেকেই অমল-যুগের তুলনামূলক ‘কোমল’ পন্থা ছেড়ে শত্রুর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেছেন নতুন জেলা সম্পাদক। বর্ধমান পুরভোটে তেমন কিছু সন্ত্রাস না হওয়া সত্ত্বেও সাতসকালেই কার্যত ‘ওয়াকওভার’ দিয়ে ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সিপিএমের বর্ধমান জেলা তথা রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। পার্টিকর্মীদের একটা বড় অংশেরই এই পশ্চাদপসরণে সায় ছিল না। তার পরেও বিভিন্ন ঘটনায় নেতারা যে ভাবে কুঁকড়ে থেকেছেন, তা-ও নিচুতলার কর্মীরা ভাল ভাবে নেননি।

জেলা জুড়ে সিপিএমের অন্তত ৩৫টি দলীয় অফিস তালাবন্ধ। কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, রায়না, খণ্ডঘোষের শতাধিক সিপিএম কর্মী এখনও ঘরছাড়া। অবস্থা বুঝে তাই প্রথম দিন থেকেই ‘প্রতিরোধ’ শব্দটির উপরে জোর দিচ্ছেন অচিন্ত্যবাবু। দীর্ঘদিন মঙ্গলকোট-কেতুগ্রামের মতো অশান্ত এলাকার দায়িত্বে থাকায় মার খাওয়া এবং পাল্টা মার দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর এমনিতেই দলের অন্য অনেক নেতার চেয়ে বেশি। অচিন্ত্যবাবুর মতে, “আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। প্রতিরোধই যে বাঁচার রাস্তা, তা মানুষ বুঝতে পারছেন।” তাঁর দাবি, কেতুগ্রামের সীতাহাটি, রায়নার কাঁইতি বা আউশগ্রামের বহু গ্রামে বাড়ির মহিলারা ঝাঁটা-বঁটি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেন। তাতেই অন্য দলের দুষ্কৃতীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তবে শুধু শাসকদলকে সামলানো নয়, সিপিএম ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার প্রবণতা রুখতে পারাটা অচিন্ত্যবাবুদের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এ দিনই বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের ফল ফের দেখিয়ে দিয়েছে, তৃণমূল নিজের ভোটব্যাঙ্ক প্রায় অটুট রেখে দিয়েছে। মূলত সিপিএমের ভোট ভাঙিয়েই শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে বিজেপি। গত বছর লোকসভা নির্বাচনেই বর্ধমান জেলায় বিজেপির ভোট এক ধাক্কায় ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আসানসোল কেন্দ্রে বিপুল ভাবে জিতেছেন বাবুল সুপ্রিয়। জেলা সম্মেলনের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, দুঃসময়ে পার্টিকে পাশে না পেয়েই অনেক কর্মী বিজেপিতে চলে গিয়েছেন।

জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন, বিজেপির বাড়বাড়ন্ত দেখেও সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তা আটকাতে পারলেন না কেন? জবাবী ভাষণে এই প্রশ্নের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিদায়ী সম্পাদক। তবে নেতাদের একটা বড় অংশই আড়ালে বলছেন, জেলা জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় আরএসএস শিবির করছে। তাদের সাংগঠনিক প্রভাব বিস্তারের দৌলতে বিজেপি বাড়ছে। অন্য দিকে সিপিএম এবং তার গণসংগঠনগুলি এমনই কুঁকড়ে রয়েছে যে বিরোধী দল হিসেবেও তাদের উপরে আর আস্থা রাখতে পারছেন জেলার মানুষ। তারই প্রতিফলন ঘটছে। অচিন্ত্যবাবু অবশ্য এ দিন দাবি করেন, “বিজেপির এই প্রভাব সাময়িক। এমনিতেই কেটে যাবে।”

অচিন্ত্য-কথা

সিপিএমের প্রথম বর্ধমান জেলা সম্পাদক, স্বাধীনতা সংগ্রামী সুবোধ চৌধুরীর পরে অচিন্ত্য মল্লিকই কাটোয়া থেকে দ্বিতীয় যিনি ওই পদে বসলেন। ১৯৭০ সালে কলেজে পড়ার সময়েই সিপিএমের সদস্য। ১৯৭১ সালে স্নাতক স্তরের পরীক্ষা দেন জেলে বসেই। ১৯৮১ সালে ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক। ১৯৮৯-১৯৯৮ দলের অবিভক্ত কাটোয়া জোনাল সম্পাদক। ১৯৯৮-এ জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। ২০০৮ সাল থেকে রাজ্য কমিটির সদস্য।

মুখে এ কথা বললেও অচিন্ত্যবাবু ভালই জানেন, রাজনীতিতে ‘এমনি’ বলে কিছু নেই। যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা সাংগঠনিক স্তরেই করতে হয়। যে কারণে বিজেপির দখলে থাকা শিল্পাঞ্চলে জোর বাড়াতে চাইছেন অচিন্ত্যবাবুরা। তাঁদের ভরসা, সিপিএম জমি হারালেও সিটুর তার প্রভাব এখনও অনেকটাই ধরে রেখেছে। সে কারণে শিল্পাঞ্চলে কর্মসূচি বাড়াতে পারলে, অস্থায়ী ও ঠিকাশ্রমিকদের আস্থা অর্জন করতে পারলে হাওয়া ঘোরানো সম্ভব বলে তাঁরা মনে করছেন। দলের একটি সূত্রের খবর, অবাঙালি ভোটব্যাঙ্ক ফিরিয়ে আনা এবং শ্রমিক-শ্রেণির মধ্যে থেকে নতুন নেতৃত্ব তুলে আনার উদ্দেশ্যে শিল্পাঞ্চলে কয়েক জনকে বিশেষ দায়িত্বও দিতে চলেছেন নতুন সম্পাদক।

জেলা সম্মেলনের আগেই টানা তিন দিন রিলে মিছিল করে অনেক দিন পরে শিল্পাঞ্চলে ভাল সাড়া পেয়েছে সিপিএম। সেই কথা তুলে অচিন্ত্যবাবুর দাবি, “যাঁরা আমাদের থেকে সরে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে আসছেন।” আগামী দু’তিন মাসের মধ্যেই কাটোয়া, কালনা, দাঁইহাট, মেমারি, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়ার মতো কিছু পুরসভায় ভোট হতে পারে। তাতে মরিয়া লড়াই দিতে তাঁরা যে ‘শাসকদলের প্রতি পক্ষপাতগ্রস্ত’ পুলিশকেও প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ জানাবেন, তা নতুন সম্পাদকের কথায় পরিষ্কার। যেমন কাল, ১৮ ফেব্রুয়ারি পাণ্ডবেশ্বরে সিপিএমের একটি অনুষ্ঠানে পুলিশ অনুমতি দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তা তোয়াক্কা না করে অচিন্ত্যবাবু বলেন, “এ বার থেকে পুলিশ অনুমতি না দিলেও নির্দিষ্ট দিনেই অনুষ্ঠান করব। তাতে মামলা হলে হবে!”

নতুন নেতার এই একরোখা মনোভাবই হয়তো এই মুহূর্তে বর্ধমান জেলা সিপিএমের কাছে সবচেয়ে বড় সুখবর। অচিন্ত্যবাবু অবশ্য বলেন, “আমাদের দলে কেউ একা নেতা হয় না। আমরা যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাসী।”

cpm achintya mallik katwa soumen dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy