Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফের নিয়োগে দুর্নীতির তিরে বিদ্ধ শাসক দল

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘টেট’ পরীক্ষার পরেই বহু জনের ধারণা হয়ে গিয়েছে, শাসক দলের নেতাদের ধরলেই চাকরি মিলবে। সেই মতো বর্ধমানে পঞ্চায়েত দফতরে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বেরোতেই তৃণমূলের বড়-মেজো-সেজো দাদার দোর ধরেছিলেন বহু চাকরিপ্রার্থী। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে দেখা গেল, সেই অঙ্ক একেবারে মেলেনি তা হলফ করে বলা যাবে না। কিন্তু দলের মধ্যেই বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলেছে বলে খেদও শোনা যাচ্ছে।

সৌমেন দত্ত ও কেদারনাথ ভট্টাচার্য
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৩
Share: Save:

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘টেট’ পরীক্ষার পরেই বহু জনের ধারণা হয়ে গিয়েছে, শাসক দলের নেতাদের ধরলেই চাকরি মিলবে। সেই মতো বর্ধমানে পঞ্চায়েত দফতরে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বেরোতেই তৃণমূলের বড়-মেজো-সেজো দাদার দোর ধরেছিলেন বহু চাকরিপ্রার্থী।

লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে দেখা গেল, সেই অঙ্ক একেবারে মেলেনি তা হলফ করে বলা যাবে না। কিন্তু দলের মধ্যেই বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলেছে বলে খেদও শোনা যাচ্ছে। বর্ধমান জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষদের একটা বড় অংশের আক্ষেপ, এক মন্ত্রী-সহ জেলার তিন বড় নেতা মর্জিমাফিক তালিকায় নাম ঢুকিয়েছেন, অন্য কারও দেওয়া নাম গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা হয়নি। ফলে, নাম তুলে দেবেন বলে যাঁরা আগেই টাকা নিয়ে বসেছিলেন, তাঁরা ফাঁপরে পড়ে গিয়েছেন।

বাম আমলেও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠী টানা নিজেদের লোক ঢুকিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু তৃণমূল জমানায় নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে শাসক দলের অন্দরে প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে কেউ পদত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন, কেউ তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। জেলার কয়েক জন শীর্ষ নেতা তালিকার ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে গলা ফাটালেও অপর পক্ষেরও যে যথেষ্ট ওজন রয়েছে, তা তাঁদের অজানা নয়।

গোটা আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল থেকে এক জনের নামও তালিকায় না ওঠায় বৃহস্পতিবারই জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের কাছে ক্ষোভ জানিয়ে এসেছেন জেলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী, জামুড়িয়া থেকে নির্বাচিত প্রিয়া সূত্রধর। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং জেলা পরিষদের মনিটরিং কমিটির সভাপতি তথা মন্ত্রী মলয় ঘটককেও পুরো বিষয়টি মৌখিক ভাবে জানিয়েছেন জেলার তিন বিধায়ক। এ দিনই বেলা ১১টা নাগাদ বিধানসভা থেকে জেলাশাসককে ফোন করে তালিকায় থাকা প্রার্থীদের নাম-ঠিকানা চেয়ে পাঠিয়েছেন মলয়বাবু। যদিও প্রকাশ্যে তিনি তা স্বীকার করেননি। পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ, শুক্রবার দলের ৬৩ জন সদস্যকে নিয়ে জরুরি সভা ডেকেছেন জেলা পরিষদের তৃণমূল দলনেত্রী অরুন্ধতী সেন।

বর্ধমান জেলায় পঞ্চায়েত সহায়ক, নির্মাণ সহায়ক-সহ পাঁচটি পদে প্রায় চারশো লোক নিয়োগের জন্য ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল পঞ্চায়েত দফতর। তার জন্য জেলাস্তরের নির্বাচন কমিটিও গড়া হয়। প্রায় ৪২ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি লিখিত পরীক্ষা হয়। বছরখানেক পরে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চারটি পদের জন্য উত্তীর্ণদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে (একটি পদ নিয়ে মামলা হওয়ায় সেটির ফল প্রকাশ হয়নি)। এ বার উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বাছাই চূড়ান্ত করা হবে।

কিন্তু ওই তালিকা বেরোনোর পরেই জেলা পরিষদের তৃণমূল কর্মাধ্যক্ষ ও সদস্যদের একটা বড় অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের দাবি, পঞ্চায়েত সহায়কের ৮২টি পদের জন্য যে ৮২০ জনের নামের তালিকা বেরিয়েছে, তার অন্তত ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে একই পরিবারের দুই থেকে পাঁচ জনের নাম রয়েছে। রয়েছে বর্ধমানের এক অতিরিক্ত জেলাশাসকের আপ্ত সহায়কের দুই মেয়ের নামও। যেমন তালিকার ১৫ ও ১৬, ২৭ ও ২৮, ৫১ ও ৫২, ৬০ ও ৬১, ৬৭ থেকে ৭১, ৯৩ থেকে ৯৬, ১৭৩ থেকে ১৭৬ নম্বরের পরীক্ষার্থীরা একই পরিবারের। এ রকম উদাহরণ অনেক রয়েছে।

ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাদের প্রশ্ন, এ কি নেহাতই কাকতালীয়? অরুন্ধতীদেবীর কথায়, “একটা গ্রাম থেকে একাধিক পরীক্ষার্থী, পরপর রোল নম্বরের পরীক্ষার্থী, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা আধিকারিকদের সন্তানেরা তালিকায় রয়েছে। যা স্বচ্ছতার ধারণার সঙ্গে মিলছে না।” স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ গোলাম জার্জিসের বক্তব্য, “আমরা যোগ্য প্রার্থীদের নামের পাশে ঠিকানা ও নম্বর দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।” গোটা তালিকায় শুধু ভাগীরথী ও দামোদর এলাকার প্রার্থীদেরই নাম রয়েছে দাবি করে প্রিয়া সূত্রধরের প্রশ্ন, “তা হলে কি শিল্পাঞ্চলের কোনও পরীক্ষার্থীই যোগ্য নয়?” দলের কর্মীদের ক্ষোভের কারণে এলাকায় ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন বলেও জেলাশাসককে জানান তিনি।

বস্তুত, এই ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তালিকা প্রকাশের পরেই দু’জন জেলা পরিষদ সদস্য পদত্যাগ করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু বলেন, “দু’জন মৌখিক ভাবে এমন ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন বটে, তবে লিখিত কিছু জমা দেননি।” দলের একটা বড় অংশ এতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন কেন? দেবুবাবুর দাবি, কর্মাধ্যক্ষদের সুপারিশ মেনে তালিকা হয়নি বলেই তাঁদের এত ক্ষোভ। রাজ্যের মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথও দাবি করেন, “স্বচ্ছতা রাখতে গিয়ে নিয়োগ কমিটি কারও সুপারিশ মানেনি। তাতে কারও-কারও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।” অথচ দলের জেলা সহ-সভাপতি (গ্রামীণ) আশিস রায় বলছেন, “অনেক ভাল ছেলের নাম তালিকায় না উঠলেও এমন কিছু পরিবারের লোকজনের নাম তালিকায় রয়েছে, যা দেখে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।”

শাসক দলের এই দুর্নীতি-দ্বৈরথে আসল শিকার হয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা চাকরি পাওয়ার আশায় কোনও না কোনও নেতাকে টাকা দিয়েছিলেন, কিন্তু তালিকায় নাম ওঠেনি। পূর্বস্থলীর এমনই এক যুবকের কথায়, “টেট দেখে আমরা বুঝে গিয়েছি, নেতাদের টাকা দিলে চাকরি হয়। তাই টাকা দিয়েছিলাম। এখন নাম না বেরোনোয় দিশেহারা লাগছে।” কাটোয়ার এক পরীক্ষার্থীর দাবি, “পরীক্ষা দেওয়ার পরে এক নেতার সঙ্গে কথা বলি। বর্ধমানে টাকা পৌঁছেও দিয়ে এসেছি। তালিকায় নাম না আসায় ওই নেতা এখন টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।” ইতিমধ্যে জেলা পরিষদের কয়েক জন সদস্যের বাড়িতে যাতায়াতও শুরু করেছেন অনেকে। এ দিন কালনা মহকুমায় এক সদস্যের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক জন গালিগালাজও করেন।

এর পরেও জেলাস্তরের নির্বাচন কমিটির সভাপতি তথা বিধানসভার পরিষদীয় সচিব উজ্জ্বল প্রামাণিক স্বচ্ছতার প্রমাণ হিসেবে বলেন, “ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার সামনে খাতা দেখা হয়েছে।” তৃণমূলের এক জেলা নেতা বলেন, “চাকরি দেওয়ার নামে কেউ টাকা তুললে তার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।” জেলা প্রশাসনের এক কর্তার পরামর্শ, “কারও ক্ষোভ থাকলে তিনি তথ্য সংক্রান্ত আইনে খাতা দেখতে চাইতেই পারেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

soumen dutta kedernath bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE