দুপুর ১টা ১০। ৮৫% ভোট পড়ে গিয়েছে। ফাঁকা বুথে গা এলিয়ে ভোটকর্মীরা। রায়নার জামনায়।—নিজস্ব চিত্র।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য উদয় সরকার বললেন, “ম্যাসাকার হয়ে গেল!” একটু পরে জামালপুর জোনাল দফতরে বসে দলের জোনাল কমিটির সম্পদাক সমর ঘোষও বললেন, “এর চেয়ে তো পঞ্চায়েত ভোট ভাল হয়েছিল।”
তাহলে কী এই লোকসভা ভোটে লালদূর্গের দুই আসনে সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই রয়ে গেল? সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পদাক অমল হালদার অবশ্য জোর গলাতেই দাবি করলেন, “না, আমরা হেরে যাইনি। ভোটের লড়াইয়ে পিছিয়েও পড়িনি। বর্ধমান পূর্বে ১৮৯২টি আর বর্ধমান দুর্গাপুরের ১৯৭০টি বুথের মধ্যে রিগিং হয়েছে ১৪১ ও ১৫৩টি বুথে। বাকি বুথে মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন। তাই আমাদের আশা এখনও অটুট।”
গত লোকসভা ভোটে রায়নায় জাকতা এফপি বিদ্যালয়ের বুথে নির্বাচন কমিশনের কার্ড থাকা সত্ত্বেও ঢোকা যায়নি। সৌজন্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। এ বার অবশ্য বুথে ঢুকতে কোনও বাধা এল না। বুথের দরজায় লাঠি হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে। তৃণমূল ছাড়া অন্য দলের এজেন্ট নেই। নেই মাইক্রো অবজার্ভার। ক্যামেরাম্যান একজন আছেন বটে। তবে তিনি ক্যামেরা ব্যাগে রেখে গল্প করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। আর বুথের প্রিজাইডিং অফিসার বলেন, “ভোট নিয়ে তো কোনও সমস্যা নেই।”
পাশের বুথ বাঁধগাছা এফপি বিদ্যালয়ে ১২টার মধ্যেই ৬৩৩-এর মধ্যে ৪২১টি ভোট পড়ে গিয়েছে। পাশের বুথে পড়েছে ৫৮৩-র মধ্যে ৪২১টি। এই বুথে সিপিএমের এজেন্ট বসেছেন অথচ পাশের বুথে নেই কেন? ঈশারায় এজেন্ট দেখালেন, মেরে তাড়ানো হয়েছে। একটু দূরে জামনা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ আলো করে বসে রয়েছেন দুর্লভদর্শন চার জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। হেসে-হেসে তাঁরা বললেন, “ভোট লেকে কোই সমস্যা তো নহি হ্যায়! ১টার মধ্যে ভোট পড়েছে ৪৭৯ ভোটের মধ্যে ৪২১টি।
বুধবার রায়না ঘুরে এমন দৃশ্যই নজরে এল। প্রায় ৩০টি বুথের মধ্যে মাত্র দু’টিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। বাকিগুলিতে ভরসা লাঠি-রাইফেলধারী পুলিশ। কোথাও মাইক্রো অবজার্ভার আছে। কোথাও তাও নেই।
বর্ধমান আরামবাগ রাস্তার উপরে সগরাই মোড়ে সিপিএমের রায়না-খণ্ডঘোষ জোনাল কমিটি দফতর দুপুরে শুনশান। একা উদয়বাবু দলের দু’-তিন জনকে নিয়ে দোতলায় বসে। দেখা হতে বললেন, “৫৪টি বুথে সকাল থেকে ছাপ্পা মারছে। অবজার্ভার, পুলিশ, ডিএম, এসপিকে ফোন করে চলেছি। কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। ভোটের নামে প্রহসন হচ্ছে।”
সকালে হিজলনা ঢোকার মুখে দেখা হয়েছিল তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতার সঙ্গে। এলাকার ডাকসাইটে ওই নেতা বলছিলেন, “আমরা যা করার সকাল সকাল করে ফেলেছি। এখন কোনও বুথে আর ঝামেলা নেই। ঝড়তি-পড়তি ভোটারেরা ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। রায়নার দুটি ব্লকে ৬০-৭০টি বুথে সিপিএমের এজেন্ট নেই।” তবে দলের তরফে সরকারি ভাষ্য দিতে গিয়ে বর্ধমান পূর্বের প্রার্থী সুনীল মণ্ডলের নির্বাচনী এজেন্ট উত্তম সেনগুপ্ত বলেন, “ভোট ভালই হয়েছে। কোথাও ঝামেলা নেই। সিপিএম যদি রায়না জামালপুরে এজেন্ট দিতে না পারে তো কী করব? এজেন্ট তো ধার দিতে পারিনা!”
জামালপুর জোনাল দফতরে খালি গায়ে বসে রয়েছেন সিপিএমের নেতা সমর ঘোষ। চশমা হেলে পড়েছে। হাতে মুঠোফোনে অনবরত খবর আসছে, বুথ থেকে এজেন্টকে বের করে দিয়েছে তৃণমূল। সমরবাবুও ফোন তুলে ধমকাচ্ছেন। হাওয়া কেমন, জিজ্ঞেস করাতে বললেন, “শুনেছেন তো? জামালপুরে ওরা ছুরি বের করেছে। আমাদের লোকেদের গায়ে যদি হাত পড়ে তাহলে কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না।” পাশে বসে আরেক নেতা পরেশ সাঁতরারও দাবি, “আমাদের এক মহিলা এজেন্টকে ওরা বলেছে, কামদুনি করে দেব। তবুও আমাদের এজেন্টরা অনেক বুথ ছেড়ে নড়েননি। হরিণ্যগ্রামে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল ওরা। তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ফের বুথে বসেছেন।” সিপিএমের অভিযোগ, জামালপুরে ৩০টি বুথে হয় এজেন্ট দিতে পারেনি সিপিএম। কোথাও এজেন্ট দিলেও মেরে তাড়ানো হয়েছে। রায়নার ৫৩ আর জামালপুরের ১৮টি বুথে পুনর্নিবাচন দাবি করে কমিশনকে চিঠি লিখেছে সিপিএম।
জামালপুরের চৌবেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, বুথের বাইরে জড়ো হয়ে রয়েছেন অনেকে। তাঁদের সকলেরই ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তাহলে পুলিশ সরিয়ে দিচ্ছে না কেন? পুলিশ কর্মীরা বললেন, “আছে থাকুক না। ওরা তো গোলমাল করছেন না!” তবে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, ওই লোকেরাই বুথে যেতে দিচ্ছেন না তাঁদের।
তৃণমূলের বর্ধমান গ্রামীণের সভাপতি স্বপন দেবনাথ অবশ্য বলেন, “কালনা, ভাতার, সরাইটিগড় প্রভৃতি এলাকায় ৪০ জন তৃণমূল কর্মী সিপিএমের হাতে মার খেয়েছেন। এদের মধ্যে কালনা হাসপাতালে, ১৬ জন বর্ধমান মেডিক্যালে ও চারজল কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এ দিন বিভিন্ন জায়গায় সিপিএমই সন্ত্রাস চালিয়ে আমাদের নামে মিথ্যে অভিযোগ করছে।” তাঁর প্রশ্ন, “কোথাও কী এজেন্ট তুলে নেওয়ার কোনও ছবি পাওয়া গিয়েছে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy