সন্ধ্যার পরে ফাঁকা দুর্গাপুর স্টেশন বাসস্ট্যান্ড। ভরসা শুধু অটো। বিকাশ মশানের তোলা ছবি।
রাত পৌনে ১০টা নাগাদ কালকা মেল থেকে দুর্গাপুর স্টেশনে নেমেছিলেন প্রণয় বসু। ফুলঝোড়ে নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য বাসের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু, সেখানে যাওয়ার শেষ মিনিবাস বেরিয়ে গিয়েছে তার ঘণ্টাখানেক আগেই। অগত্যা ট্যাক্সি চড়তে হল তাঁকে। মওকা বুঝে ইচ্ছে মতো ভাড়া নিল সেই ট্যাক্সি।
এক রবিবার বাসে চড়েছিলেন বি-জোনের বিদ্যাপতি এলাকার শর্মিষ্ঠা রায়। টিকিট কাটার সময়ে কন্ডাক্টর জানিয়ে দেন, তিনি যেখানে যেতে চান, আজ বাস তত দূর যাবে না। কারণ, ও দিকের আর কোনও যাত্রী নেই। তর্ক করেও লাভ হয়নি।
দুর্গাপুরের রাস্তায় বেরিয়ে এ ভাবে ভোগান্তির মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা কম-বেশি বহু বাসিন্দারই রয়েছে। গত কয়েক বছরে অনেক ঝাঁ চকচকে হয়েছে এই শহর। জনগণনা অনুযায়ী, ১৯৯১ সালের দুর্গাপুরে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ২৫ হাজার। ২০১১ সালে তা হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ ৬৭ হাজার। অর্থাৎ, দু’দশকে বাসিন্দা বেড়েছে এক লক্ষ ৪২ হাজার। তার উপরে শহর আধুনিক হওয়ার সঙ্গে বাইরে থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা লোকের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু শহরবাসীর অভিযোগ, গণ পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করার কোনও ব্যবস্থা হয়নি।
এক সময়ে দুর্গাপুরে ছিল কিছু সরকারি ও বেসরকারি কল-কারখানা ও তাদের টাউনশিপ। ডিএসপি, এমএএমসি, এইচএফসিএল, বিওজিএল বা বেসরকারি এবিএল, পিসিবিএলের মতো সংস্থার কর্মীরা থাকতেন টাউনশিপে। তখন শহর এত আধুনিক ছিল না। বেশির ভাগ বাড়িতেই যাতায়াতের জন্য একটি মোটরবাইক রাখা হত। ট্রেন বা দূরপাল্লার বাস ধরতে যেতে হলে তখন একমাত্র টাউন সার্ভিস বাসের খোঁজ পড়ত। এ ছাড়া বেনাচিতি, সগড়ভাঙা, গোপালমাঠের মতো শহুরে এলাকা বা করঙ্গপাড়া, নডিহা, রাতুরিয়া, অঙ্গদপুর, বীরভানপুর, আমরাইয়ের মতো শহর লাগোয়া গ্রামীণ এলাকাও ছিল। তখন গণ পরিবহণ ব্যবস্থা বলতে ছিল সরকারি সংস্থা দুর্গাপুর রাজ্য পরিবহণ সংস্থার বাস। স্টেশনে যাতায়াতের জন্য গুটিকয়েক বাস চলত। যাত্রী তেমন না হওয়ায় এক সময়ে উঠেই যায় পরিবহণ সংস্থাটি। বদলে চালু হয় কম আসনের মিনিবাস পরিষেবা।
এক দিকে দুর্গাপুর স্টেশন। ও দিকে বেনাচিতির প্রান্তিকা। স্টেশন থেকে সরাসরি অথবা এ-জোন বা বি-জোন হয়ে বেনাচিতি— প্রথম প্রথম এই তিন রুটেই মিনিবাস চলত। পরে এমএএমসি, বিধাননগর ইত্যাদি রুটেও মিনিবাস চালু হয়। আরও পরে চালু হয় মায়াবাজার, নডিহা, ৫৪ ফুট প্রভৃতি রুট। সমস্যার শুরু নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে। আধুনিকীকরণের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ডিএসপি। যার স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার, ঠিকাকর্মী প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। এই সময় থেকেই দুর্গাপুরে একের পর এক বেসরকারি কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। পরের দিকে তৈরি হয় তারকা হোটেল, শপিংমল। সরকার রাজ্যের অন্যতম ‘এডুকেশন হাব’ হিসেবে দুর্গাপুরকে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিতেই পরপর গড়ে ওঠে ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আইটি পার্ক। গড়ে ওঠে মাল্টিপ্লেক্স, বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার শো-রুম। চাকরি, পড়াশোনার জন্য বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় এক ধাক্কায় অনেকটা। তত দিনে আধুনিক জীবনযাত্রার ছোঁয়া লেগেছে শহরে। আগের তুলনায় রাতে রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল বেড়েছে। অথচ, সন্ধ্যায় কেনাকাটা সেরে বা রেস্তোঁরায় খাওয়া-দাওয়ার পরে বাড়ি ফেরার যানবাহন নেই।
২০০৭ সালে নতুন দশটি রুটে মিনিবাস চালানোয় উদ্যোগী হন পুরসভার তৎকালীন মেয়র পারিষদ (পরিকল্পনা) তথা প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী। শুধু শহরের ভিতরেই নয়, নতুন রুটে শহরের সঙ্গে গ্রামীণ এলাকাকেও জোড়া হয়। কিন্তু, মিনিবাস পরিষেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ যাত্রীদের। তাঁদের অভিযোগ, যেখানে-সেখানে যতক্ষণ খুশি বাস দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছনের বাসটি দেখতে পেলে তবে এগিয়ে যায় পরের স্টপের দিকে। আগে দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বেনাচিতি, এ-জোন, বি-জোন এবং ৫৪ ফুট রুটের শেষ বাস ছাড়ত রাত ১০টা ১০-এ। বিধাননগর যাওয়ার শেষ বাস ছাড়ত রাত সাড়ে ৯টায়। এমএএমসি-র শেষ বাস স্টেশন ছাড়ত রাত ৯টা ১০ নাগাদ। মায়াবাজার ও নডিহার শেষ বাস ছিল রাত সওয়া ৯টায়। কিন্তু, এখন এ-জোন, বি-জোন, মায়াবাজার এবং এমএএমসি-গামী শেষ বাস ছাড়ে রাত পৌনে ৯টা নাগাদ। হাওড়া থেকে অগ্নিবীণা (বিধান) এক্সপ্রেস দুর্গাপুর পেরিয়ে যাওয়ার পরে তারা আর অপেক্ষা করে না। মুচিপাড়া, বিধাননগর হয়ে প্রান্তিকাগামী ৮বি রুটের শেষ বাস ছাড়ে রাত ৯টা ৩৫ নাগাদ। একমাত্র বেনাচিতির বাস পাওয়া যায় রাত ১০টা ৪০ পর্যন্ত। অর্থাৎ, তার পর স্টেশনে নামলে ট্যাক্সি বা অটোয় চড়া ভাড়া গুণে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় নেই। ডিএসপি টাউনশিপ, বিধাননগর ইত্যাদি এলাকা থেকে অনেকেই সিটি সেন্টারে আসেন সন্ধ্যার পর। কিন্তু, সময় কাটে ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে। কারণ, সাড়ে ৯টার পরে আর ফেরার বাস নেই।
কেন এই পরিস্থিতি? বাস মালিকেরা জানান, জ্বালানির দাম বেড়েছে। যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়েনি ভাড়া। ফলে, লাভ তলানিতে ঠেকেছে। বহু বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আগে রাতে যাত্রী পর্যাপ্ত না হলেও মানবিক কারণে বাস চালানো হতো। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। ‘দুর্গাপুর মিনিবাস অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি অলোক চট্টোপাধ্যায় এবং ‘দুর্গাপুর প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক কাজল দে বলেন, “আগে গণ পরিবহণ বলতে ছিল শুধু মিনিবাস। আয় অনেক বেশি ছিল। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যাত্রী কম হলেও বেশি রাত পর্যন্ত বাস চালানো হতো। এখন আর সে দিন নেই।”
বাসের মালিক ও কর্মীদের আরও অভিযোগ, সমস্যা আরও বাড়িয়েছে বেআইনি ভাবে চলা অটো। রুটের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মতো চলা অটো পরিবহণ ব্যবস্থার ক্ষতি করেছে বলে দাবি তাঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy