বাম আমলে একসঙ্গেই উদ্বোধন হয়েছিল মঞ্চ দু’টির। এখন অবশ্য একটির সামনে গমগমে ভিড়, রমরমিয়ে চলছে নিত্যনতুন সিনেমা আর আগাছায় মুখ ঢেকে বেহাল পড়ে রয়েছে আরেকটি মঞ্চ।
১৯৮৭ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একই সঙ্গে শিলান্যাস করেছিলেন সংস্কৃতি লোকমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চের। কিন্তু দিনের পর দিন লোকমঞ্চের জৌলুস বাড়লেও কার্যত এক কোনে পড়ে রয়েছে মুক্তমঞ্চ। এমনকী সংস্কৃতি লোকমঞ্চর পাশে সংস্কৃতি মেট্রো নামের আরও একটি অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন হয়েছে গত বাম আমলে। সেটাও চলছে রমরমিয়ে। কিন্তু মুক্তমঞ্চের হাল ফেরেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারাই জানান, একটা সময় তো ইট, কাঠ, রড ডাঁই করে রাখা হত মুক্তমঞ্চের ওই জায়গায়। পরে অবশ্য কিছুটা জায়গা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে মঞ্চ চিহ্নিত করা হয়। বর্ধমান পুরসভা বেশ কিছুদিন আগে বিশাল একটা মঞ্চও গড়ে দিয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইট-সিমেন্টের মঞ্চে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়নি। নাটকের দলগুলি ওই মঞ্চে অভিনয়ে বিশেষ আগ্রহ না দেখানোয় ক্রমেই অব্যবহারে ভেঙে পড়ছে মঞ্চ, আগাছায় ভরে গিয়েছে জমি।
মুক্তমঞ্চ ট্রাস্ট কমিটির সম্পাদক তপন চৌধুরীর কথায়, “আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংস্থার সঙ্গে আদানপ্রদান গড়ে তুলতে, নাটক যাত্রা ইত্যাদি নিয়ে মতামত দেওয়া নেওয়ার জন্য, সবার উপরে বাংলার অবহেলিত লোকশিল্পের বিকাশ ও প্রসারে একটি মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রচুর পরিশ্রম করে অর্থ সংগ্রহ করে শহরের কেন্দ্রস্থল খালুইবিল মাঠে সোয়া বিঘের মত জমিও কিনেছিলাম। কিন্তু আমাদের স্বপ্নের মুক্তমঞ্চ আজও অধরাই রয়ে গেল।”
ওই সওয়া বিঘে জমির একপাশে এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিমেন্টের তৈরি এক বিশাল অসমাপ্ত মঞ্চ। আজ পর্যন্ত কোনও নাটক বা যাত্রা অভিনীত হয়নি সেখানে। হয়নি কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। কিন্তু এই জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনবরত চাপ আসছে বলে দাবি সম্পাদকের। তপনবাবু ২০১২ সালের কমিটির তরফে বের হওয়া প্রতিবেদনে লিখেছিলেন,“মুক্তমঞ্চ স্বার্থপর দৈত্যের বাগান হল, এমন অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। শিশুদের খেলাধূলা, বয়স্কদের বৈকালিক ভ্রমণের জন্য মুক্তমঞ্চ এলাকার সন্নিহিত কিছু উদ্যোগী মানুষের (অবশ্যই রাজনৈতিক) মুক্তমঞ্চ অধিগ্রহনের প্রয়াস (চাপ) অবিরত চালু রয়েছে।”
অথচ তার আগের বছরই মুক্তমঞ্চ ট্রাস্ট কমিটির তরফে ওই মঞ্চের সার্বিক উন্নয়নের জন্য মন্ত্রী তথা বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়েছিল, এই মঞ্চ নির্মিত হলে বর্ধমান মুক্তমঞ্চের প্রাণপুরুষ, যাত্রা অভিনেতা শম্ভু বাগ, যাত্রা জগতের শেষ জ্যোতিষ্ক নটশেখর রাখাল সিংহ, পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়-সহ আরও অনেক লোকশিল্পের অমর স্রষ্টাদের প্রতি ঋণ পরিশোধ করা হবে। মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ওই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করলেও, আজও তাঁর কাছ থেকে ওই মঞ্চকে পূর্নাঙ্গ রূপ দেওয়ার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগের কথা জানা যায়নি বলে তপনবাবুদের দাবি।
মন্ত্রী তথা বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান রবিরঞ্জনবাবু অবশ্য বৃহস্পতিবার বলেন, “মুক্তমঞ্চের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণের ব্যাপারে ওঁরা আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। পরে সম্ভবত আর আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়নি। ওঁরা নতুন করে দেখা করে ওঁদের ঠিক কী চাই জানালে, আমি উদ্যোগ নিতে পারি।”
কিন্তু বর্ধমানের নাটকের দলগুলি এই মঞ্চ ব্যবহার করছে না কেন?
প্রবীণ নাট্য সংগঠক ও মুক্তমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত মৃদুল সেন বলেন, “আমিই নিজেই ১৯৮৭ সালের ২৬ মে জ্যোতিবাবুকে নিয়ে গিয়ে ওই মঞ্চের শিলান্যাস করাই। কিন্তু দীর্ঘদিন কমিটিতে থাকা লোকেরাই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। পরে বর্ধমানের প্রাক্তন পুরপ্রধান আইনূল হককে ধরে মঞ্চের উপরে ছাউনি করি। কিন্তু লজ্জা করে ভাবতে যে কিছু লোক এই মঞ্চ ব্যবহারের জন্য নাটকের দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগই করেনি।”
শহরের এক ড্রামা কলেজের অধ্যক্ষ ললিত কোনারের আবার দাবি, “ওই মুক্তমঞ্চ নিয়ে তৈরি হওয়া কমিটিতে আমাদের ডাকা হয়নি। ওখানে নাটক করতে বললে করব। কিন্তু ডাক তো পাইনা।” প্রবীণ নাট্যশিল্পী গোপা চৌধুরী বলেন, “যেখানে আমাদের ডাকা হয়েছে, সেখানেই নাটক করতে গিয়েছি। কিন্তু মুক্তমঞ্চ থেকে ডাক পাইনি।”
নাট্যশিল্পী উদয় মুখোপাধ্যায়, রাতুল চক্রবর্তী, অমিতাভ চন্দ্রদের অভিযোগ, “মুক্ত মঞ্চ কমিটির তরফে তেমন কোনও উদ্যোগই নেই। কম খরচে নাটক করতে পারব যেখানে সেখানে তো যেতেই পারি। তবে ওই মঞ্চের সামনে দর্শকদের বসার জায়গায় কোনও ছাউনি নেই। তাই দর্শকদের বসতে সমস্যা হবে।”
পারস্পরিক টানাপড়েনে মুক্তমঞ্চের হাল ফিরবে কবে, সে উত্তর অধরাই।