Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বারবার হামলা করেও অনুতপ্ত হন না ওঁরা

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাবালিকা সায়েকা পরভিনের মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সিএমআরআই হাসপাতাল। চিকিৎসকের গাফিলতিতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।

ক্ষুব্ধ: সায়েকা পরভিনের পরিজনেদের কান্না। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

ক্ষুব্ধ: সায়েকা পরভিনের পরিজনেদের কান্না। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৯ ০১:৫০
Share: Save:

একবালপুরের ভূকৈলাস রোড। রবিবার ছুটির দুপুরে সেখানকার বাঘকুটি মোড়ে দাঁড়িয়ে কিশোরীর নাম, তার বাবার নাম বললেও চিনতে পারেন না কেউ। তবে চিকিৎসায় ‘গাফিলতি’তে মৃত্যুর কথা বলতেই বিভ্রান্ত ভিড়টা হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘আরে ওই মেয়েটা তো! একবালপুরের হাসপাতালে যে মারা গিয়েছিল। চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।’’

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাবালিকা সায়েকা পরভিনের মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সিএমআরআই হাসপাতাল। চিকিৎসকের গাফিলতিতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। প্রতিবাদে পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ। সেই বিক্ষোভ ছড়ায় অন্য বেসরকারি হাসপাতালেও। ওই ঘটনার পরে দু’বছর চার মাস কেটে গেলেও বাঘকুটি মোড় এলাকার অনেকের এখনও ধারণা, হাসপাতালের গাফিলতিতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। পুলিশি ধরপাকড়, কড়া আইন এবং পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও তাঁদের সেই ধারণা বদলায়নি। কিশোরীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে এক যুবক বললেন, ‘‘ধারণা বদলাবেও না। পুলিশ যাঁদের ধরেছিল, সবাইকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। দোষ থাকলে তো শাস্তি দেবে।’’

চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশের অভিযোগ, হাসপাতালে ভাঙচুর বা ডাক্তারকে মারধরের ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলেও কয়েক দিন পরেই তাঁরা জামিন পেয়ে যান। তাঁদের দাবি, কড়া শাস্তি না থাকায় দোষীদের মধ্যে আসলে কোনও অপরাধবোধই কাজ করে না। এন আর এস হাসপাতালের আন্দোলন থেকেও চিকিৎসক নিগ্রহে ধৃতদের নজিরবিহীন শাস্তির দাবি উঠছে। এই পরিস্থিতিতে এ দিন একবালপুর থানায় দু’বছর আগের সিএমআরআই-কাণ্ডের খোঁজ করে জানা গেল, ওই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল রাকেশ ধনুক, জিয়াউদ্দিন শেখ ও শেখ সোনি নামে তিন জনকে। তাঁদের প্রত্যেকেই এখন জামিনে মুক্ত। তবে তাঁরা কেউই আর একবালপুরের পুরনো পাড়ায় থাকেন না।

বাঘকুটি মোড়ের পুরনো বাড়িতে থাকে না সায়েকার পরিবারও। তাঁরা যেখানে উঠে গিয়েছেন সেখানে পৌঁছে জানা গেল, সায়েকার বাবা মহম্মদ কামাল এবং দাদা মহম্মদ জাহির কাজে বেরিয়েছেন। তাঁদের খাবার হোটেল রয়েছে। বাড়িতে আছেন সায়েকার দিদি রুকসানা খাতুন এবং মা সুলতানা বেগম। মেয়ের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে আসা শুনেই সুলতানার দাবি, ‘‘আমার মেয়েকে মেরে আমাদেরই মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল।’’

মহিলা বলতে থাকেন, ‘‘পেটে ব্যথা নিয়ে সিএমআরআইয়ে ভর্তি করেছিলাম মেয়েকে। ডাক্তারবাবুরা বলেন, তেমন কোনও ব্যাপার নেই। সুস্থ হয়ে যাবে। দেড় লক্ষ টাকা আগে জমা করতে হবে। কোনও মতে ধার করে ৪০ হাজার টাকা দিই। কিন্তু, রাত তিনটে নাগাদ মেয়েটা মারা যায়। আর মাথার ঠিক ছিল না।’’ সিএমআরআই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য পুরনো এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে মন্তব্য করতে চাননি। তবে ওই মৃত্যুর পরেই একবালপুর এলাকা থেকে জড়ো হওয়া অন্তত একশো জনের ভিড় হাসপাতালে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ ছিল।

লালবাজারের নির্দেশে তৎপর হয় স্থানীয় থানা। তিন জনকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশের নজরে ছিলেন মৃতার ভাই-সহ আরও অনেকে। তবে সুলতানা এখনও অনুতপ্ত নন তাঁর পুত্র জাহিরের কাজে। বললেন, ‘‘বোনের মরদেহ দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি ছেলে। হাসপাতালের একটা কাচ ভেঙে দেয়। ওকেও পুলিশ খুঁজছিল। তিন মাস পরে ছেলে ঘরে ফিরেছে।’’

পুলিশের নজরে থাকা সেই জাহির কি অনুতপ্ত? ফোনে মায়ের সুরেই তিনি বললেন, ‘‘যা করেছি, রাগের মাথায় করেছি। তবে ভুল করেছি মনে করি না। রোগী নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে ডাক্তারদের দুর্ব্যবহার কি মারধরের থেকে কম?’’

মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘আসলে ভাবখানা এমন যে, মানুষ অমর। তাঁরা মারা যাচ্ছেন ডাক্তারদের জন্যই। কড়া আইনও নেই, আর ডাক্তার ছাড়া অন্য কোনও মহল থেকে ডাক্তার পেটানোর কড়া প্রতিবাদও হয় না। তাই দোষ করেও কেউ অনুতপ্ত নন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE