Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
State News

এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ টন পেঁয়াজ চলে গেল বাংলাদেশে, চড়া দামে নাশিকের পেঁয়াজ কিনে খাচ্ছি আমরা

পেঁয়াজ চাষিদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাজ্যের যা চাহিদার প্রায় সবটাই ভিন্‌রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়। কারণ, এ রাজ্যের সিংহ ভাগ পেঁয়াজই রফতানি করা হয় প্রতিবেশী বাংলাদেশে।

ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারত ‘বাংলার পেঁয়াজ’। মত, বঙ্গের পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের একাংশের। ছবি: পিটিআই।

ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারত ‘বাংলার পেঁয়াজ’। মত, বঙ্গের পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের একাংশের। ছবি: পিটিআই।

সোমনাথ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৭:১৯
Share: Save:

রাজ্যে সারা বছর পেঁয়াজের যা চাহিদা তার ৬৫ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন করে পশ্চিমবঙ্গ। তার পরেও পেঁয়াজের জন্য তাকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় ভিন্‌রাজ্যের দিকে! সৌজন্যে ‘সংরক্ষণ ব্যবস্থা’। এ রাজ্যে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা যদি মহারাষ্ট্রের মতোও করা যেত, তা হলে এই দুর্দিনের মুখ দেখতে হত না রাজ্যবাসীকে। বরং এই সঙ্কটের সময়ে ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারত ‘বাংলার পেঁয়াজ’। এমনটাই মত, এ বঙ্গের পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের একাংশের।

সারা দেশে পেঁয়াজের যে চাহিদা, তার একটা বড় অংশ আসে মহারাষ্ট্র থেকে। এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গের ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ আসে মহারাষ্ট্রের নাশিক থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ দক্ষিণ ভারত থেকে আসে। কিন্তু এ রাজ্যেও তো পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। রাজ্যের চাহিদা মেটাতে তার ভূমিকা কী? সরকারি টাস্ক ফোর্সের এক সদস্য জানাচ্ছেন, প্রতি বছর এ রাজ্যে ৮ লক্ষ মেট্রিক টনের কাছাকাছি পেঁয়াজ লাগে। এখন বিভিন্ন জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয় প্রায় ৫ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ রাজ্যে তিন লক্ষ মেট্রিক টন ঘাটতি। সেই ঘাটতির অংশটুকুই তো আমদানি করলে হয়ে যাওয়া উচিত? তা হলেই তো পেঁয়াজের দাম সারা বছর নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা?

কিন্তু পেঁয়াজ চাষিদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাজ্যের যা চাহিদার প্রায় সবটাই ভিন্‌রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়। কারণ, এ রাজ্যের সিংহ ভাগ পেঁয়াজই রফতানি করা হয় প্রতিবেশী বাংলাদেশে। কী বলছেন ওই চাষির? তাঁদের দাবি, আগে হুগলি, নদিয়া, বাঁকুড়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় পেঁয়াজ চাষ হত। এখন প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে। সে কারণে উৎপাদনের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু চাষ করলেই তো হল না, ওই পেঁয়াজ সংরক্ষণও তো করতে হবে!

সারা দেশে পেঁয়াজের যে চাহিদা, তার একটা বড় অংশ আসে মহারাষ্ট্র থেকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যে ভাবে বাঁশের মাচা করে ধাপে ধাপে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে হয়, টাকার অভাবে তা করতে পারছেন না চাষিরা। সরকারি উদ্যোগও নেই বলে অভিযোগ। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে পেঁয়াজ যখন ওঠে, মাঠ থেকে তা তুলে সরাসরি আড়তদারদের কাছে চলে যেতে হচ্ছে চাষিদের। সনাদন দাস নামে নদিয়ার এক চাষি জানালেন, আড়তদাররা সেই সুযোগটা নেয়। কম পয়সায় পেঁয়াজ কিনে তাঁরা মজুত করে প্রতিবেশী বাংলাদেশে রফতানি করে। সনাতনের কথায়, ‘‘ফলে আমাদের পেঁয়াজের বেশির ভাগটাই চলে যায় অন্য দেশে। মুনাফা লোটেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আমরা যদি সংরক্ষণ করতে পারতাম, তা হলে ফেব্রুয়ারিতে ওঠা পেঁয়াজ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খুব কম দামে বিক্রি হত বাজারে। কিন্তু প্রতি বছর একই কারবার!’’

আরও পড়ুন: বাইকে যাওয়া তৃণমূল নেতাকে পিছন থেকে পর পর গুলি করে খুন কালনায়

রাজ্যে তো প্রচুর হিমঘর রয়েছে। সেখানে সংরক্ষণ করা যায় না পেঁয়াজ? মুর্শিদাবাদের চাষি শেখ সফিউল্লা বললেন, ‘‘পেঁয়াজ সংরক্ষণের পদ্ধতিটা একেবারেই আলাদা। কিন্তু আলুর মতো পেঁয়াজ সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ তেমন ভাবে নেই। সে কারণেই প্রতি বছর ক্ষতির মুখে পড়তে হয় আমাদের। এখন তো রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি পেঁয়াজের ফলন হয়। তা সত্ত্বেও আরতদারদের কাছে ৪-৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হই আমরা। এ বার তো তেমন ফলনও হয়নি। আরও খারাপ দিন আসছে আমাদের।’’

চাষিদের কথা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, এ রাজ্যের পেঁয়াজ রফতানি হয়ে যায় বাংলাদেশে। আর নিজেদের পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় ভিন্‌রাজ্য থেকে। গত ফেব্রুয়ারিতে এ রাজ্যে পেঁয়াজের যে ফলন হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। জুন-জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশেও এ রাজ্যের পেঁয়াজ রফতানি হয়েছে। তবে, এ দেশে পেঁয়াজ সঙ্কট শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চাষিদের অভিযোগ, পেঁয়াজ ব্যবসায়ী কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী বাংলাদেশে এ রাজ্যের পেঁয়াজ রফতানি করছেন, তিনিই আবার অন্য সময় মহারাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। সফিউল্লার কথায়, ‘‘বিষয়টা কেমন হল বুঝলেন! আমাদের পেঁয়াজ কম দামে কিনে বাংলাদেশে রফতানি করে এক বার মুনাফা। আবার ভিন রাজ্যের পেঁয়াজ এখানে আমদানি করে সেখান থেকেও লাভ লুটছেন ওঁরা। সরকার বসে বসে দেখছে।’’

কবে যে দাম কমবে, তার নিশ্চয়তাও দিতে পারছে না রাজ্য। ছবি: পিটিআই।

এ বছর যে হেতু মহারাষ্ট্র বৃষ্টি-বন্যার কারণে পেঁয়াজ তেমন ভাবে পাঠাতে পারছে না, তাই এ রাজ্যের বাসিন্দারা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহতে ১৪০-১৫০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনছেন। শনিবারও পোস্তা-বড়বাজারে ১০০ টাকার আশপাশে পাইকারি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। ফলে খুচরো বাজারে দাম কমার নাম নেই। কবে যে দাম কমবে, তার নিশ্চয়তাও দিতে পারছে না রাজ্য। কেন্দ্রের ঘাড়ে বন্দুক রাখছে তারা। এ রাজ্যের সরকারের গড়ে দেওয়া টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য কমল দে বলেন, ‘‘আগে থেকে কেন্দ্রের কড়া পদক্ষেপ করা উচিত ছিল। কারণ নাশিকের অনেক ব্যবসায়ী বন্যার দোহাই দিয়ে বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ মজুত করে রেখেছে। চাষিরা দাম পাননি, সে রাজ্যে। কিন্তু পেঁয়াজের বড় ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে মুনাফা লুটছে। কেন্দ্রের নজরদারি কোথায়? উল্টে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, আমি তো পেঁয়াজ খাই না। কিন্তু আম আদমি তো খায়। সেটা ওঁরা বুঝছেন না।’’

আরও পড়ুন: ‘এনআরসি তো ঘচাং, মুন্ডু গেলে খাব কী!’

এই পরিস্থিতি গোটা ডিসেম্বর মাস জুড়েই চলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। কমলবাবু জানাচ্ছেন, কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে চলছে টাস্ক ফোর্স এবং এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের নজরদারি। কিন্তু, বাংলার পেঁয়াজকে নিয়ে সরকারি কোনও ভাবনার কথা শোনাতে পারছেন না কেউই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Onion Price Hike Onion Price Maharashtra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE