Advertisement
E-Paper

রোদ্দুর হয়ে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ (১৯২৪-২০১৮)

সেই লেখার শেষে নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এখন একদম শয্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব...।’

প্রয়াত কবি। — ফাইল চিত্র।

প্রয়াত কবি। — ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:০০
Share
Save

চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। মঙ্গলবার বেলা ১২টা ২৫ মিনিট নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৯৪।

বেশ কিছু দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। সম্প্রতি শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে। কয়েক দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সোমবার সকালে তাঁর হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি নীরেন্দ্রনাথ।

কবির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সাহিত্য জগতের বিশিষ্টরা। শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে এ দিন সন্ধ্যায় নিমতলা শ্মশানে। কবির দেহ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শায়িত থাকবে রবীন্দ্র সদনে। তার পর সেখান থেকে বাংলা আকাদেমি হয়ে বাঙুর অ্যাভিনিউয়ে নীরেনবাবুর বাড়ি পৌঁছবে দেহ। সন্ধে সাড়ে ৭টায় শেষকৃত্যের জন্য কবির দেহ নিয়ে যাওয়া হবে নিমতলা শ্মশানে।

তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। শোকবার্তায় তিনি জানিয়েছেন, ‘জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়। সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত সেই কবি চলে গেলেন আজ। তাঁকে আমাদের প্রণাম।’

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ।

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ

ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’... অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল...’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়...’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘কাঁধে হাত রেখে ওই নিরুচ্চার হাসির দাম মেটাতে পারবে না কবিতাও’

কবিতাই তাঁর মাতৃভাষা ছিল। তবে, খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে নানা রকমের গদ্যও লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজে মনে করতেন, ‘কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।’ বলতেন, ‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।’ এ প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন, ‘এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’

আরও পড়ুন: সৌজন্য-সম্ভ্রমের প্রকাশ দ্বিজেনদা

এ বছরের ২৯ জুলাই মারা গিয়েছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। বন্ধুর স্মৃতিচারণায় ‘দেশ’ পত্রিকায় নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না।... ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’ সেই লেখার শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন একদম শয্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব...।’

সেই ‘শিগগিরি’ যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তা কি নীরেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন? বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি রোদ্দুর হয়ে রয়ে গেলেন। তাঁর কবিতার রোদস্পর্শ আমাদের ছুঁয়ে যাবে, কিন্তু তাঁকে আর ধরা যাবে না!

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

Nirendranath Chakraborty Bengali Poet নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy