E-Paper

বাংলায় কথা: সন্দেহেই গ্রেফতার

সোমবার থেকে বলবৎ হওয়া অভিবাসন ও বিদেশি আইনে স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৭
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে গিয়ে বাংলায় কথা বলেন। আপনার মূল ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গের। তা হলে আপনি আসলে বোধহয় বাংলাদেশি! এ বার শুধুমাত্র সেই সন্দেহের বশে বাংলাভাষী ব্যক্তিকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে পারবে পুলিশ। লাগবে না কোনও পরোয়ানা।

গত সোমবার থেকে বলবৎ হওয়া অভিবাসন ও বিদেশি আইনে স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। পদর্মযাদায় যিনি হেড কনস্টেবল হলেই চলবে। ওই আইন কার্যকর হওয়ায় বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে কর্মরত বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা আরও বাড়তে চলেছে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পাল্টা বিজেপির বক্তব্য, যাঁরা দেশের নাগরিক, বৈধকাগজপত্র রয়েছে তাঁদের চিন্তা করার তো কিছু নেই।

কেন্দ্র জানিয়েছিল, ভারতে প্রবেশ করছেন বা ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এমন ব্যক্তির কাছে পাসপোর্ট ও ভ্রমণ নথির প্রয়োজনীয়তা এবং ভিসার নথিভুক্তি, বিদেশিদের ভারতে থাকা সম্পর্কিত নিয়ম মেনে চলার জন্য গত বাজেট অধিবেশনে বিলটি সংসদে পাশ হয়। আইনে বলা হয়, ভারতে থাকাকালীন বিদেশিদের কাছে পাসপোর্ট ও বৈধ ভিসা থাকতে হবে। না হলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে কিছু ক্ষেত্রে (যেমন প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘু শরণার্থী) ছাড়দিয়েছে কেন্দ্র।

কিন্তু ওই আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও পুলিশ (হেড কনস্টেবল বা তাঁর উপরের পদমর্যাদার) মনে করেন, কোনও ব্যক্তি বিদেশি এবং তাঁর কাছে বৈধ নথি নেই, তিনি কেবল সন্দেহের বশে সন্দেহভাজনকে বিদেশি বলে গ্রেফতার করতে পারবেন। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির কথায়, ‘‘থানার নিচু তলার এক জন কর্মীর হাতে কমিশনারের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে দেশের মানুষকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করতে ওই আইন ব্যবহার হতে পারে।’’ নতুন ওই আইনটি কার্যত ভারতে আসা বিদেশিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করবে বলেই মত বিরোধীদের। শিক্ষা, চিকিৎসা বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে কোনও বিদেশি দেশে এলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা হোটেল বা হোম-স্টে-কে বিদেশিদের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে হবে প্রশাসনকে। সিঙ্ঘভির কটাক্ষ, ‘‘বিদেশিরা আগামী দিনে অতিথি নন। তাঁদের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে সন্দেহ করা হবে।’’

তবে পুলিশের হাতে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়াই চিন্তায় রেখেছে বিরোধীদের। সম্প্রতি বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের বিদেশি সন্দেহে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বৈধ কাগজ থাকলেও, তাঁদের বিদেশি বলে টাকা চাওয়া হচ্ছে। না পেলে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হচ্ছে। বিরোধীদের বক্তব্য, এ বার তো সেই ধরপাকড়কে আইনি রক্ষাকবচ দিয়ে দিল কেন্দ্র। সন্দেহের বশে যে কাউকে গ্রেফতার করা হতে পারে। ফলে ভিন রাজ্যে কর্মরত বাঙালি মুসলিম পরিযায়ীদের উপর পুলিশের জুলুম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল সাংসদ সামিরুল ইসলাম।

ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বলেই মনে করছেন রাজনীতিকদের একাংশ। তাঁদের মতে, আগামী বছরের ভোট না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ধরপাকড় জারি থাকবে। হিন্দু সমাজকে একজোট হওয়ার বার্তা দিতে দফায় দফায় বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার চেষ্টা হবে। সামিরুল বলেন, ‘‘ধরপাকড় বাড়লে হিন্দু-মুসলিম, উভয় ধর্মের পরিযায়ী শ্রমিকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিভাজনের রাজনীতিতে কারও ভাল হতে পারে না।’’

গেরুয়া শিবিরের একাংশের মতে, মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের কারণে দেশের সীমান্তের জন্যবিন্যাস পাল্টানোর পাশাপাশি দেশবাসীর জীবিকায় টান পড়েছে। সে কারণেই অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে তৎপর হয়েছে মোদী সরকার। বিজেপির একাংশের দাবি, ওই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমর্থক এবং ওই সমর্থন সরে গেলে রাজ্যে পালাবাদল সম্ভব। তাই পরিকল্পিত ভাবে মুসলিম পরিযায়ীদের নিশানা করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনীতিকেরা।

তা ছাড়া বিজেপি নীতিগত ভাবে বিশ্বাস করে, দেশভাগ এখনও ‘সম্পূর্ণ হয়নি’। অসংখ্য হিন্দু প্রতিবেশী দেশগুলিতে রয়ে যাওয়ায় তাঁরা ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার হচ্ছেন। যাঁদের এই সরকার ভারতে আসার প্রশ্নে আইনি সুবিধা দিতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদ তথা সিএএ আন্দোলনকারী প্রসেনজিৎ বসুর প্রশ্ন, ‘‘সিএএ কিংবা অভিবাসন আইন—এ ধরনের আইনগুলির কাঠামো এক। তা হলে কি এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে চলে আসার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে?’’ একই সঙ্গে বাংলাদেশে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাভাষী মুসলিমদের। বিজেপি-কথিত ‘অসম্পূর্ণ দেশভাগ’ সম্পূর্ণ করতেই তা করা হচ্ছে কি না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

migrant labour

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy