ক্রেনের সাহায্যে লাইনচ্যুত কামরাগুলিকে সরানোর চেষ্টা করছে উদ্ধারকারী বাহিনী। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক
কামরার দুই দেওয়ালের মাঝে চেপ্টে আছেন এক যাত্রী দম্পতি এবং তাঁদের শিশু। তখনও উদ্ধারকারী দল আসেনি। আশেপাশের বাসিন্দা কয়েক জন জড়ো হয়েছেন। উল্টে যাওয়া, হেলে পড়ে থাকা কামরা থেকে যাত্রীদের টেনে বার করছেন তাঁরা। কিন্তু দুমড়ে যাওয়া দুই দেওয়ালের মাঝে আটকে থাকা যাত্রীদের সে ভাবে বার করা সম্ভব নয়। অন্ধকারে কেউ একটা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘একটা গ্যাস কাটার থাকলেই দেওয়াল কেটে বার করা যেত।’’ ভিড়ের মধ্যে থেকে আর এক জন চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘গ্যাস কাটার! আনছি আমি!’’ তার পর ছুট লাগালেন আল পথ ধরে।
অন্ধকার নেমে আসা ফাঁকা মাঠে তখন ছিটকে রয়েছে যাত্রী বোঝাই ১২টি কামরা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চলে এল গ্যাস কাটার। ময়নাগুড়ির গ্যারাজ চালানো রাম রায় নিজের গ্যাস কাটার নিয়ে এলেন। এলাকাবাসী কয়েক জন নিজেদের বাড়ি থেকে রান্নার সিলিন্ডার নিয়ে এলেন। শুরু হল উদ্ধারকাজ। ওই গ্যাস কাটার দিয়েই উদ্ধার চলল রাতভর। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর উদ্ধারকারী দল এসেছে দুর্ঘটনার অনেক পরে। তার আগেই এই ভাবে উদ্ধার শুরু করে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাদিন্দারা।
রাত তখন ১১টা। অন্তত ১৫০ অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে। আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স এসেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এমনকি অ্যাম্বুল্যান্স চালকরাও নিজেরা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিলেন দুর্ঘটনাস্থলে। ময়নাগুড়ি শহরের ওষুধের দোকানগুলি খোলা রইল রাতভর। ট্রেনের কোনও জখম যাত্রীর যদি ওষুধ প্রয়োজন হয়! ব্লাডব্যাঙ্কের সামনে ছিল লম্বা লাইন। সকলেই আর্তদের জন্য রক্ত দিতে চান।
রাত যত গড়িয়েছে উদ্ধারে ততই এসে জুটেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তখন মধ্যরাত। শীতের আকাশে ঝকঝক করছে শুক্ল একাদশীর চাঁদ। নীচে একটি কামরা কেটে বার করা হচ্ছে যুবককে। তার দু’টি পায়ের নীচের অংশ কেটে বাদ দিতে হয়েছে। রেলের এক আধিকারিক তাঁকে ক্রমাগত সান্ত্বনা দিয়ে বলে চলেছেন, ‘‘বেটা, হিম্মত মত হার না।’’ আশেপাশে ভিড় করে একদল বাসিন্দা, উদ্ধারকারী দল। মধ্যবয়সী সেই ব্যক্তিকে জীবিত বার করতেই হাততালি দিয়ে উঠল ভিড়। ব্যথায় কাতর সেই ব্যক্তি হাততালি শুনে দু’হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে উপরে তোলার চেষ্টা করেও পারলেন না, হাত দু’টো এলিয়ে পড়ল স্ট্রেচারে।
মধ্যরাত পার করে জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার-সহ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘটনাস্থলে। রাত আড়াইটের সময় হঠাৎই শোরগোল উঠল, একটি কামরায় যাত্রী আটকে। সকলে মিলে ধরাধরি করে বার করে আনলেন তাঁকে। যাত্রী সংজ্ঞাহীন। এলাকাবাসীরা যাত্রীর বুকে হাত দিয়ে স্পন্দন
বোঝার চেষ্টা করলেন। এলাকার এক মহিলা বললেন, ‘‘শরীরটায় আর প্রাণ নাই।’’ তার পর পরই রেলের ঘোষণা, উদ্ধারকাজ শেষ, ট্রেনের কামরায় আর কেউ আটকে নেই। সংক্রান্তির আগের রাতে তখন খোলা মাঠে বৃষ্টির মতো হিম পড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy