Advertisement
E-Paper

পরিস্থিতি নেই আন্দোলনের, চাপের পাহাড়ে গুরুঙ্গ

একটা সময়ে না একের পর এক বেপরোয়া চাল দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই সব চাল অজান্তে তাঁর পায়ের তলা থেকেই মাটি সরিয়ে নিয়েছে একটু একটু করে। মদন তামাঙ্গ হত্যা মামলার চার্জশিটে নাম উঠে যাওয়াটা তাই বিমল গুরুঙ্গের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়াল বলে মনে করছেন অনেকে। কেন? রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করা অনেকে বলছেন, হাতে ক্ষমতা পেয়ে একই সঙ্গে সমস্ত পক্ষের বিরাগভাজন হয়ে বসেছেন গুরুঙ্গ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার থেকে শুরু করে আমজনতা— চটিয়েছেন সব পক্ষকেই। আজ গুরুঙ্গ ও তাঁর স্ত্রী-সহ মোর্চা শীর্ষ নেতৃত্ব সিবিআই চার্জশিটে অভিযুক্ত হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে তাঁর দরকার ছিল একটা জোরদার রাজনৈতিক আন্দোলন। ২০১০-এর গুরুঙ্গ হলে হয়তো সেটা করতে তাঁর খুব অসুবিধে হতো না।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০৩:২২

একটা সময়ে না একের পর এক বেপরোয়া চাল দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই সব চাল অজান্তে তাঁর পায়ের তলা থেকেই মাটি সরিয়ে নিয়েছে একটু একটু করে। মদন তামাঙ্গ হত্যা মামলার চার্জশিটে নাম উঠে যাওয়াটা তাই বিমল গুরুঙ্গের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়াল বলে মনে করছেন অনেকে।

কেন?

রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করা অনেকে বলছেন, হাতে ক্ষমতা পেয়ে একই সঙ্গে সমস্ত পক্ষের বিরাগভাজন হয়ে বসেছেন গুরুঙ্গ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার থেকে শুরু করে আমজনতা— চটিয়েছেন সব পক্ষকেই। আজ গুরুঙ্গ ও তাঁর স্ত্রী-সহ মোর্চা শীর্ষ নেতৃত্ব সিবিআই চার্জশিটে অভিযুক্ত হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে তাঁর দরকার ছিল একটা জোরদার রাজনৈতিক আন্দোলন। ২০১০-এর গুরুঙ্গ হলে হয়তো সেটা করতে তাঁর খুব অসুবিধে হতো না। কিন্তু ২০১৫-য় (বিশেষত এই সময়ে) একটা পুরোদস্তুর প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার অবস্থায় তিনি নেই বলেই মনে করছেন অনেকে।

তাঁদের যুক্তি, গুরুঙ্গের নিজের ভুলেই চোরা ধস নেমেছে মোর্চার জনসমর্থনে। তিনি লাগাতার আস্ফালন করে এসেছেন যে, গোর্খাল্যান্ড তাঁর হাতের মুঠোয়। কিন্তু বাস্তবে তেলঙ্গানা তৈরি হয়েছে, কিন্তু গোর্খাল্যান্ড স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। উল্টে মোর্চার লাগাতার পাহাড় অচলের জেরে স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। পর্যটন ব্যবসায়ী, গাড়িচালকদের ব্যবসা মার খেয়েছে। ফলে মোর্চার উপর চাপ বেড়েছেআন্দোলন প্রত্যাহার করার। এই মে-জুন মাসেও পর্যটনের ভরা মরসুম। গুরুঙ্গের দলের লোকেরাই বলছেন, এই সময়ে সিবিআই চার্জশিট নিয়ে পুরোদস্তুর আন্দোলনে নামতে গেলে পাহাড়বাসীর সমর্থন তো মিলবেই না, উল্টে হিতে বিপরীত হবে।

মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘দলে আলোচনা করেই সব সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। কাজেই সভাপতির কাজ নিয়ে ক্ষোভের কথা আমাদের অন্তত জানা নেই।’’ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্যকে একযোগে চাপে ফেলার চেষ্টাটাই ছিল গুরুঙ্গের সব চেয়ে বড় ভুল। বাম আমলে বন‌্ধ-অবরোধে পাহাড় অচল করে সুবাস ঘিসিঙ্গের স্বপ্নের ষষ্ঠ তফসিলের বিলকে হিমঘরে পাঠিয়ে উত্থান হয়েছিল গুরুঙ্গের। তৃণমূল জমানার গোড়ায় তেমন ভাবেই আসরে নেমেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া মনোভাব দেখে পাহাড় অচলের রাস্তায় হাঁটা ছাড়তে হয় মোর্চা নেতৃত্বকে। তাদের প্রথম সারির নেতা বিনয় তামাঙ্গ সহ প্রায় ২২০০ জনকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। এ ছাড়া স্থানীয় অসন্তোষ তো ছিলই।

সে যাত্রা আন্দোলন তুলে গুরুঙ্গকে ঘোষণা করতে হয়েছিল, যাবতীয় আন্দোলন করবেন দিল্লিতে। তার পর বিজেপির জোটসঙ্গী হয়ে সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে জিতিয়েছে মোর্চা। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে দিল্লিতে গিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে তারা। কিন্তু সেই সফরেই ধর্নায় বসেছে যন্তর-মন্তরে। আবার দিল্লি থেকে পাহাড়ে ফিরেই রোশন গিরি-রা প্রচার চালিয়েছেন যে, কেন্দ্রের সাহায্যে আলাদা রাজ্য আদায় করে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনকী যোগগুরু রামদেবকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে তাঁকে দিয়েও গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে সমর্থন করানো হয়েছে। এর কোনওটাই ভাল ভাবে নেননি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বস্তুত, অহলুওয়ালিয়া বলেছেন, ‘‘বিজেপি কিন্তু কখনওই গোর্খাল্যান্ড দেবে বলে লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে লেখেনি। পাহাড়বাসীর দাবি বিবেচনার কথা বলা হয়েছিল।’’ বরং রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে গুরুঙ্গদের এই তৎপরতা ভাল ভাবে নেননি মমতাও। এমনকী জিটিএ-র টাকা যাতে রাজ্যের হাত না ঘুরে সরাসরি তাঁদের কাছে আসে, সেই দাবিও তুলেছিলেন গুরুঙ্গরা।

এই অবস্থায় স্বভাবতই আজ গুরুঙ্গের কোণঠাসা দশা। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন মোদী ও মমতার পারস্পরিক সম্পর্কে সাম্প্রতিক সৌজন্যের বাতাবরণ। দিল্লির পরে কলকাতায় বৈঠক থেকে শুরু করে মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরে মমতার সঙ্গী হওয়া— গোটা আবহটাই গুরুঙ্গের পক্ষে অস্বস্তির। সিবিআই চার্জশিটের পিছনে এই সমীকরণের দিকে ইঙ্গিত করছে গুরুঙ্গের ঘনিষ্ঠ মহল। অহলুওয়ালিয়া অবশ্য বলেছেন, ‘‘সিবিআই একটা স্বাধীন সংস্থা। তারা একটা চার্জশিট দিয়েছে, তার পেছনে রাজনৈতিক তাৎপর্য খোঁজা ঠিক নয়।’’

বিজেপি নেতৃত্বের একাংশও বলছেন, মোদী-মমতার ‘সাংবিধানিক’ সৌজন্যের অর্থ এই নয় যে, সারদা কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হলে তৃণমূল শিবিরকে ছাড় দেওয়া হবে। একই ভাবে পাহাড়ে জোটসঙ্গী হলেও মোর্চা কোনও বিশেষ সুবিধে পাবে না। সিবিআই তাদের কাজ করবে।

তবে সিবিআইয়ের চার্জশিটের পরে আগামী বিধানসভা ভোটে মোর্চা-বিজেপি সমীকরণ বদলাবে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। পাহাড়ে টানা বনধ চলার সময়ে মোর্চার বিরুদ্ধে একাধিক বার সুর চড়িয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি।’’

সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম অবশ্য সরাসরি গুরুঙ্গদের গ্রেফতারির দাবি তুলেছেন। তবে শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘মদন তামাঙ্গ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানাচ্ছিলাম। সিবিআই নিশ্চয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ শোনাচ্ছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘‘গুরুঙ্গদের রাজনীতি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ওরা যে আজ বিজেপি, কাল তৃণমূলের ছায়ায় সুবিধা ভোগ করছে তা ক্রমেই সামনে এসে পড়েছে।’’ আপাতত চাপের পাহাড়ে গুরুঙ্গ অবশ্য একাকীই।

Bimal Gurung madan tamang murder case morcha police mamata bandopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy