Advertisement
E-Paper

মেয়েদের রাত দখলের ‘অরাজনৈতিক’ ধাক্কা পথে নামাল ‘রাজনীতিকে’! শুক্রে সাক্ষী কলকাতা

শুক্রবার গোটা দিন একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচি কলকাতায়। মুখ্যমন্ত্রীর পদযাত্রার পাশাপাশি বিজেপির বিক্ষোভ, মিছিল। অনেক দিন পরে এ ভাবে রাস্তায় দেখা গেল পদ্মশিবিরকে।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৪ ২৩:৩৯
BJP and opposition parties returns in street after the sucess of reclaim the night programme

(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুকান্ত মজুমদার (ডান দিকে)। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাত শাসন করা ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পথে নামিয়ে ছাড়ল রাজ্যের শাসক থেকে বিরোধী সব রাজনীতিকেই। ১৪ এবং ১৫ অগস্টের সেই সন্ধিক্ষণকে ঘিরে রাজ্য জুড়ে যে মিছিল-জমায়েত হল, যার ডাক এবং নেতৃত্ব ছিল প্রধানত মেয়েদের হাতে, তাতে দলীয় পরিচয় ছিল ব্রাত্য। ‘দলহীন’ সেই জনস্রোত কতটা ঠেলা মারল বিভিন্ন দলকে তার সুস্পষ্ট আভাস মিলল শুক্রবার। ফাঁসি চেয়ে মিছিলে হাঁটলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি দফায় দফায় বিক্ষোভ চালাল কলকাতায়। খবরে রইলেন বামেরাও।

আরজি কর-কাণ্ডের পর পর আন্দোলন যখন আছড়ে পড়ছে ওই হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে এবং বাইরে, তখন প্রধান বিরোধী দলকে কার্যত ‘দূরবীন’ দিয়ে খুঁজতে হয়েছিল। বাম-বিজেপি দু’পক্ষই আরজি করের অন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করে পারেনি। বাইরে থেকে আন্দোলিত হওয়ার চেষ্টা করলেও তার ছাপ জনমানসে খুব একটা ছিল না। শাসক দল তৃণমূলের কোনও স্তরের কোনও সংগঠন আলাদা ভাবে কোনও কর্মসূচি নেয়নি। তবে প্রথম থেকে আরজি কর নিয়ে মুখ খুলে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে।

শুক্রবার মমতা মিছিলে নামলেন আরজি কর-কাণ্ডে ‘বিচার’ চেয়ে। ১৪ অগস্ট যখন ‘রাত দখলের’ প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেয়েরা, তখন হাজরা এবং বেহালার প্রাক্‌-স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি কয়েক দিনের সাংগঠনিক কর্মসূচির ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা মতোই শুক্রবার মৌলালি থেকে ধর্মতলা মিছিল করেন। মিছিল থেকে ধর্মতলার মঞ্চ, সর্বত্রই অগ্রভাগে রাখলেন মেয়েদের। মমতার মিছিল যখন ধর্মতলার মঞ্চের কাছে, তখনই শ্যামবাজারে রাস্তায় বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের। তার কিছু ক্ষণ আগেই লালবাজারে আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক শেষ করেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। প্রায় একই সময়ে সাংবাদিক বৈঠক করতে বসেন সিপিএমের যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তার পরে পরেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এবং আলাদা করে শুধু সাংবাদিক বৈঠক করতে কলকাতায় এলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।

বক্তব্য সকলেরই এক। মমতা থেকে স্মৃতি সকলেই আরজি কর-কাণ্ডে দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন। একই সঙ্গে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যও ছিল। শাসকের দাবি, বুধবার রাতে আরজি করে হামলা চালায় বিজেপি ও সিপিএম কর্মীরা। অন্য দিকে, বিরোধীদের এক সুরে দাবি, তৃণমূলই লোক পাঠিয়ে হামলা চালিয়েছে। সেই দাবিকে সামনে রেখেই শুক্রবার ১২ ঘণ্টার বাংলা বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল এসইউসিআই। তা তেমন সাড়া ফেলতে না-পারলেও বিক্ষিপ্ত ভাবে পথে নামে তারা। বিজেপির ডাকেও কয়েকটি জেলায় পথ অবরোধ হয়। সন্ধ্যায় কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশে যেতে চাওয়া বিজেপি মহিলা মোর্চার মিছিল শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায় পুলিশের বাধায়। তাতে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন মহিলা মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি ভনতি শ্রীনিবাসন-সহ কেন্দ্রীয় নেতারা। দিনের শেষে রাজভবনে অভিযোগ জানাতে যান বিজেপির এক প্রাক্তন ও এক বর্তমান সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

এমন একটা রাজনৈতিক ঘটনাবহুল দিনের জন্ম যে ঘটনাকে ঘিরে, আরজি কর হাসপাতালের সেই ধর্ষণ ও খুন নিয়ে শাসক বা বিরোধী দল এতটা সক্রিয় হত কি, মেয়েরা একটা বেনজির রাতের উদাহরণ তৈরি না করলে? এমন প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। অঘটন জানাজানি হওয়ার দিন কলকাতা ছিল ভারাক্রান্ত। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অন্তিম যাত্রা মিটতে না মিটতেই ভিড় জমে আরজি করের সামনে। পৌঁছে যান মিনাক্ষীরা। কিছু পরে বিজেপির তরফে সজল ঘোষ, অগ্নিমিত্রা পালেরা। পরের দিন নির্যাতিতার বাড়িতে একে একে যান তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপির প্রতিনিধিরা। তবে মমতার সক্রিয়তায় ক্রমশ ম্লান হয়ে যান বিরোধী নেতানেত্রীরা। এরই মধ্যে কলকাতার এক মেয়ে রিমঝিমি সিংহ ‘রাত দখল করো’ আন্দোলনের ডাক দিয়ে দেন।

সেই আন্দোলন মূলত বাম ও অতি বাম মহিলাদের হবে ভেবে প্রথমে রাজনৈতিক দূরত্ব রাখে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। ১৪ অগস্ট বুধবার বিজেপির মহিলা মোর্চা আলাদা করে মিছিলও করে কলকাতায়। কিন্তু একটু একটু করে বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারে সাধারণের আন্দোলন হয়ে উঠতে চলেছে রাত দখলের ডাক। নেতাদের পরিবারের মহিলারাই ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চের সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। তখনও পর্যন্ত বিজেপি নেতারা রাতের মিছিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা চাননি। বিজেপির তরফেই মধ্যরাতে শঙ্খধ্বনীর ডাক আসে। তবে শুভেন্দু রাতের মিছিলকে মৌখিক সমর্থন জানিয়ে রেখেছিলেন। আর বিধায়কদের নিয়ে বিধানসভা চত্বরেই বিক্ষোভ দেখান। সন্ধ্যার পরে ‘জাগরী’ নামে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মধ্যরাতে রাস্তায় নামার ঘোষণা করেন বিধায়ক অগ্নিমিত্রা। সন্ধ্যা গড়াতেই বিজেপি নেতারা বুঝে যান গোটা রাজ্যেই অসংখ্য মানুষ দল-মত ভুলে রাস্তায় নামতে চলেছেন। এর পরে সুকান্ত সরাসরি ‘রাত দখল’-কে সমর্থন জানিয়ে ভিডিয়ো বার্তা ছড়িয়ে দেন।

শুক্রবার থেকে শ্যামবাজারে বিজেপি লাগাতার ধর্নায় বসবে বলে ঘোষণা করেছিল বিজেপি। কিন্তু আগাম অনুমতি না থাকায় মঞ্চই বাঁধতে দেয়নি পুলিশ। মঞ্চ বাঁধার চেষ্টা করতে গিয়ে দুপুরের দিকে প্রথমে গোলমাল হয়। পুলিশের সঙ্গে বচসাও চলে পদ্ম-কর্মীদের। বিকেলে ফের কয়েক জন রাজ্য নেতাকে নিয়ে শ্যামবাজারে যান সুকান্ত। রাস্তায় বসে পড়লে পুলিশ তাঁদের আটক করে লালবাজারে নিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় বিজেপি কলকাতার ঘটনাকে জাতীয় রাজনীতির বিষয় করে তুলতে বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী শহরে এক জন করে নেতা পাঠায় সাংবাদিক বৈঠক করতে। তারই অঙ্গ হিসাবে কলকাতায় আসেন স্মৃতি। তৃণমূলের নিন্দা করেন গোটা ঘটনার জন্য। তবে বিজেপির মূল কর্মসূচিই ছিল হাজরা থেকে কালীঘাট মশাল মিছিল। সেটি কার্যত শুরুই করা যায়নি।

লোকসভা নির্বাচনে আশাভঙ্গের বিজেপি ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। সুকান্ত মন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় রাজ্য সভাপতি থাকবেন না সেটা নিশ্চিত হলেও এখনও নতুন নাম ঘোষণা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে খানিক ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে যায় পদ্ম-শিবির। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নানা মন্তব্য দলের মধ্যে বিতর্ক তৈরি করলেও বিজেপিকে রাজনৈতিক আলোচনায় আনতে পারেনি। অন্য দিকে, শুভেন্দুর ‘বিধানসভায় আছি, সংগঠনে নেই’ অবস্থানও অস্বস্তিতে ফেলে বিজেপিকে। এমনই সব পরিস্থিতির মধ্যে থাকা বিজেপি অবশেষে রাজনৈতিক ময়দানে নেমে ঘোষণা করতে পারল— ‘হারিয়ে যায়নি দল’। দেশে লোকসভা নির্বাচনে ‘শূন্য’ পাওয়ার ধারা বজায় রাখা সিপিএমও অবশেষে রাস্তায়। সবারই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে রাস্তায় রাত জাগা মিছিল। আর সেই রাতে আরজি করে হামলা নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ খানিক অক্সিজেনও জুগিয়েছে বিরোধীদের।

Kolkata Doctor Rape and Murder R G Kar Medical College And Hospital Incident Reclaim the night West Bengal BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy