কথা ছিল কোনও রাজনৈতিক ছোঁয়াচ থাকবে না। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেল ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠে’র মঞ্চে রইলেন সাধু-সন্তেরাই। ব্যারিকেড পার করে দর্শকাসনে রইলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক অগ্নিমিত্রা পাল, লকেট চট্টোপাধ্যায়েরা। তবে শেষ পর্যন্ত ঘরে ঘরে গীতা পাঠের যে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠল, তাতে স্বস্তিই পেলেন তাঁরা।
সনাতন সংস্কৃতি সংসদ, মতিলাল ভারত তীর্থ সেবা মিশন ও অখিল ভারতীয় সংস্কৃতি পরিষদ— তিন সংগঠন যৌথ ভাবে রবিবার কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠে’র আয়োজন করেছিল। যে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আসছেন না, আগেই জানানো হয়েছিল। উপস্থিত থাকতে না পারলেও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন মোদী। সেই বার্তা মঞ্চে বড় পর্দায় দেখানোও হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই যে হেতু সব রকমের প্রচার হয়েছিল, তাই তিনি না-আসায় ব্রিগেডে ভিড় নিয়ে চিন্তায় ছিলেন সংগঠকেরা। সূত্রের খবর, রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা ভিড় টানতে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ব্রিগেডের মূল মাঠ বেশ খানিকটা ছোট করে ঘেরা হয়েছিল। সেই মাঠ ভর্তি হয়েছে কানায় কানায়। শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, এক লক্ষের বেশি মানুষের জমায়েত হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বারবার দাবি করেছেন, গীতা পাঠের আয়োজনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়-সহ রাজ্যের সব দলের সব জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে সংগঠকদের দাবি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত সাধু-সন্তদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করতে দিল্লি গিয়েছিলেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বকে ভারতের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার ভগবৎ গীতা।’’ অনুষ্ঠান শেষে শুভেন্দু বলেন, ‘‘লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমি আধ্যাত্মিক ভাবে সমৃদ্ধ বোধ করছি।’’
রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘ব্রিগেড মাঠে কেন করলেন? ফ্লপ করবে জেনেই প্রধানমন্ত্রী আসেননি। গীতার প্রতি, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে ওই মাঠ থেকে সুকান্ত, শুভেন্দুরা যে রাজনৈতিক তরজা করেছেন, তা হত না।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘যেটা বাড়িতে বসে পড়ার কথা, সেটাই ব্রিগেডের মাঠে নিয়ে এলে গীতা এবং গীতাকে যাঁরা বিশ্বাস করেন, উভয়ের প্রতিই অবিশ্বাস দেখানো হয়।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের কটাক্ষ, ‘‘দশটা বছর সীতার স্বামীকে নিয়ে রাজনীতি করলেন, নীতার বরকে পুরো দেশ বিক্রি করলেন। এখন গীতা পাঠ করে বাঁচতে চাইছেন!’’
ব্রিগেডে এ দিন পুরুষেরা সাদা ধুতি অথবা পাজামার সঙ্গে পাঞ্জাবি এবং মহিলারা লাল পাড় সাদা শাড়িতে উপস্থিত হন। দূরের জেলাগুলি থেকে শনিবার রাতেই প্রচুর মানুষ কলকাতায় চলে আসেন। খোল-করতাল, কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, ‘হরি বোল’ ধ্বনি দিয়ে তাঁরা আসেন। প্রথমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তার পরে দ্বারকা মঠের শঙ্করাচার্য সদানন্দ সরস্বতী বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ‘‘সঙ্কটকালে অস্ত্র তুলে নেওয়াই গীতার শিক্ষা। দেশ এখনও অনেক সঙ্কটের মধ্যে আছে।’’ এর পরে নজরুল ইসলামের ‘হে পার্থসারথি’ গাওয়া হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে গীতার পাঁচটি অধ্যায় পাঠ করা হয়। শেষে হয় মঞ্চে রাখা জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তিতে আরতি। কর্মসূচি চলাকালীন মুহুর্মুহু ধ্বনি ওঠে, ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, গীতা পাঠ ঘরে ঘরে’। ছিল ‘জয় শ্রী রাম’ ও ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনিও। বঙ্গ বিজেপির একাংশের মত, এর পরে হিন্দুত্বের হাওয়া তোলা যাবে। বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘বাংলায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের যত মত, তত পথের বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করতে হিন্দু জাতির সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রতিফলন এই গীতা পাঠ।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)