বাংলায় ভোটার তালিকার বিশেষ আমূল সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক উত্তাপ। নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিককে (সিইও) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারির জেরে এ বার বাধল নয়া বিতর্ক।
কমিশনকে ‘হুমকি’ দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে শুক্রবার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরে অভিযান করলেন বিজেপি বিধায়কেরা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপির বিধায়কেরা দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে নির্বাচনী আধিকারিক ও নির্বাচন কর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন, তার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হবে। রাজ্যের সিইও মনোজ আগরওয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে বলে বৃহস্পতিবার যে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, আগামী সোমবার বিকাল ৫টার মধ্যে তার তথ্য দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন শুভেন্দু। কমিশন কোনও ব্যবস্থা না-নিলে দীপাবলির পরে সিইও দফতরের বাইরে তাঁরা পাল্টা ধর্নায় বসবেন বলেও জানিয়েছেন বিরোধী নেতা। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কটাক্ষ, মুখ্যমন্ত্রী ‘ভোট চুরির ষড়যন্ত্র’ ধরে ফেলায় হতাশা থেকে বিজেপির এই আচরণ।
বিজেপি বিধায়কদের নিয়ে সিইও দফতরে অভিযোগ জানিয়ে শুভেন্দু বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী আধিকারিককে নিম্নরুচির আক্রমণ করেছেন। যে ভাষা উনি ব্যবহার করেছেন, সেটা প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কমিশনকে হুমকি দেওয়ার মতো। সিইও-র বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি এবং এক আধিকারিককে ধমকানোর অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তার প্রেক্ষিতে কী তথ্য আছে আপনার কাছে? সোমবার বিকেল ৫টার মধ্যে এটা যদি প্রকাশ ও প্রমাণ না করতে পারেন, ধরে নেব মুখ্যমন্ত্রী এসআইআর নিয়ে ভয় পেয়েছেন! আমরাও আপনার আধিকারিকদের এবং দফতরের আধিকারিকদের ‘দুর্নীতির সিরিজ’ বলব!” সিইও-র নিরাপত্তার জন্য তাঁর দফতর এবং বাড়িতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবিও তুলেছেন শুভেন্দু। তার পাশাপাশিই বলে রেখেছেন, “সিইসি এবং সিইও ব্যবস্থা না নিলে, দীপাবলির পরে কয়েক হাজার লোক, বিধায়কদের এনে দু’শো মিটার দূরে নিয়ম মেনে অবস্থান করব। নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার না এলে উঠব না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনের উপরে নন।”
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ পাল্টা বলেছেন, ‘‘আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট চুরির ষড়যন্ত্র ধরে ফেলায় বিজেপির নেতারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী আর এজেন্সি ছাড়া ভোটের কথা ওঁরা ভাবতেই পারেন না। সেই হতাশা থেকেই কখনও রাজ্যের ভোটারদের নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কখনও কমিশন, এজেন্সি আর কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন।’’ সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বা সরকার সঠিক সময়ে নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ দেবে। অপেক্ষা করুন।’’
সিইও-র দফতর অবশ্য এই বিতর্কে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেনি। তবে কোনও আমলার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ও নির্দিষ্ট জায়গায় অভিযোগ জানাতে হয়, হলফনামা-সহ তথ্য দাখিল করতে হয়। তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ভাবে অনুসন্ধান শুরু হয়। কিন্তু অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর জেল পর্যন্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের সিইও আগরওয়াল এখন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে (ডেপুটেশন) রয়েছেন। প্রশাসনিক সূত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে, সিইও নিয়োগের আগে আগরওয়াল-সহ একাধিক আধিকারিকের অভিজ্ঞতা এবং ভিজিল্যান্স ক্লিয়ারেন্স রাজ্য পাঠিয়েছিল কমিশনে। অর্থাৎ ভিজিল্যান্স ক্লিয়ারেন্সের মাধ্যমে রাজ্য কমিশনকে জানিয়েছিল, আগরওয়াল-সহ বাকিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনও অভিযোগ নেই। প্রবীণ এক কর্তা এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “আর জি কর-কাণ্ডে আন্দোলনের সময়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের ডেকে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে আধিকারিকদের একাংশের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম-সহ একাধিক অভিযোগ করা হয়েছিল চিকিৎসকদের তরফে। তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, কারও বিরুদ্ধে আচমকা এমন অভিযোগ আনা যায় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি কী ভাবে এমন অভিযোগ তুলতে পারেন পদ্ধতি এড়িয়ে!”
মুখ্যসচিবকে পাশে নিয়ে সিইও তথা কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে, এক জন সর্বভারতীয় স্তরে আইএএস অপর এক সিনিয়র আইএএসের বিরুদ্ধে রীতি বা প্রথাবিরুদ্ধ মৌখিক তোলা অভিযোগের শরিক হয়ে গিয়েছেন। প্রশাসন তথা আধিকারিকদের শীর্ষ পদে থেকে তিনি কী ভাবে শরিক হতে পারেন, প্রবীণ কর্তাদের একাংশ সেই প্রশ্নও তুলছেন।
রাজনৈতিক স্তরে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার প্রশ্ন তুলেছেন, “দেশে আমাদের মূল বিরোধী কংগ্রেসের কোনও মুখ্যমন্ত্রীও এমন বিরোধিতা করেননি। এখানে কেন? ভিতরে অন্য গল্প?’’ তাঁর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আসলে খেপাচ্ছেন যে, ‘নেমে অশান্তি করো’। আমি সবাইকে বলব, অশান্তি করবেন না। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামবে, গুলি চলবে। আপনার (সাধারণ মানুষের) পরিবারের লোক মারা যাবে। মমতার পরিবারের লোক গিয়ে স্টেশন ভাঙবেন না।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীরও প্রশ্ন, ‘‘সিইও-র অনেক ত্রুটি যদি মুখ্যমন্ত্রীর জানা থাকলে তিন জনের মধ্যে এঁর নাম পাঠিয়েছিলেন কেন? তার মানে কি আপনার পক্ষে থাকলে সাত খুন মাফ আর আপনাকে সাহায্য না করতে পারলে অপরাধ?’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)