রংবেরঙের খুদে বাস, ট্যাক্সি, মোটরবাইক। ছোটদের যা প্রিয় সঙ্গী। আর এই ধরনের খেলনায় বিস্ফোরক ভরে ছদ্মবেশী মারণাস্ত্র তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়েই বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের একাংশ প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ করছেন।
তদন্তকারীদের ধারণা, হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় বোমা-গুলির ‘গবেষণাগারে’ বসে যারা আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি করত, তারা দেশি গ্রেনেড বানাতে সিদ্ধহস্ত হলেও এই ধরনের খেলনা-বোমা তৈরিতে তেমন দড় ছিল না। সেই কারণেই কোনও ভুলচুকের জেরে সম্ভবত বিস্ফোরণ ঘটেছে। যে ধরনের ৫৫টি দেশি গ্রেনেড ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তেমন কোনও আইইডি কিন্তু ফাটেনি। আসলে বিস্ফোরণ হয়েছে খেলনায় বিস্ফোরক ঠাসার সময়ে।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা যায় এমন প্রচুর রাসায়নিক, বুলেট তৈরির জিনিসপত্র এবং টাইমার ডিভাইসের পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে প্রচুর চিনা খেলনা গাড়িও উদ্ধার করা হয়েছে। ওই বাড়িতে শাকিল আহমেদ ও আবদুল হাকিমের স্ত্রীদের সঙ্গে দু’টি শিশুও থাকত। কিন্তু তারা যে ঘরে থাকত, খেলনাগুলি সেখানে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গিয়েছে ওই ‘গবেষণাগারে’। তা ছাড়া, এক ও দেড় বছরের দু’টি বাচ্চার জন্য এত বেশি খেলনা গাড়ি থাকতে পারে না বলেও মনে করছেন গোয়েন্দারা।
সেই কারণেই তাঁদের সন্দেহ, ছোট ছোট খেলনা গাড়িতে বিস্ফোরক ভরে আইইডি তৈরির পর পাচার করার নতুন দায়িত্ব সম্ভবত শাকিল, সুবহান, হাকিমদের উপর পড়েছিল। সে জন্যই এক লপ্তে প্রচুর খেলনা গাড়ি কেনা হয় এবং গবেষণাগারে সেই ছদ্মবেশী আইইডি তৈরিরই মহড়া চলছিল। বিস্ফোরণ ঘটে তখনই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের খেলনা বোমা কখনও টাইমার ডিভাইস দিয়ে ফাটানো হয়, আবার কখনও ওই আইইডি এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে, কোনও
কিছুর সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগলেই বিস্ফোরণ ঘটবে।
এ ভাবেই দামোদর তীরে নিষ্ক্রিয় করা হয় মিনি গ্রেনেডগুলি।—ফাইল চিত্র।
বস্তুত, এই খেলনা বোমার তত্ত্ব খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে একটি নতুন দিক খুলে দিতে পারে বলে গোয়েন্দাদের অনেকেই মনে করছেন। তাঁদের মতে, খেলনা বোমা তৈরির অর্থ, বর্ধমানের ওই জঙ্গি ডেরায় সমস্ত আইইডি বাংলাদেশে পাচার করার উদ্দেশ্যেই তৈরি হচ্ছিল, এমনটা না-ও হতে পারে। কারণ, এই ধরনের ছদ্মবেশী আইইডি বাংলাদেশের নাশকতায় ব্যবহার হওয়ার তেমন নজির নেই। ভারতেও এই ধরনের আইইডি জঙ্গিরা ব্যবহার করেছে বলে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বছর দশেক আগে দিল্লির করোল বাগ এলাকা থেকে কামরান গোহর নামে লাহৌরের বাসিন্দা এক ব্যক্তিকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ডিটোনেটর ও টাইমার লাগানো কয়েকশো খেলনা গাড়ি এবং তিন কেজি আরডিএক্স। ওই ব্যক্তি জেরায় কবুল করে, দিল্লির একটি সিনেমা হল-সহ কয়েকটি জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোই তার লক্ষ্য ছিল।
তবে উল্টোটাও সত্যি হতে পারে। হতে পারে, জামাতুল মুজাহাদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর যোগসূত্রে খাগড়াগড়ে তৈরি হওয়া দেশি গ্রেনেডের সঙ্গে ওই খেলনা বোমাও এ বার বাংলাদেশে পাঠানোর কথা ছিল। এ-ও হতে পারে যে, ওই ধরনের ভেকধারী আইইডি-র কিছু অংশ বাংলাদেশে আর বাকিটুকু ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যোগসূত্রে ভারতেরই কোথাও নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল শাকিল, কওসরদের। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বেশ কয়েক বার এই ধরনের খেলনা বোমার বিস্ফোরণে শিশুদের প্রাণ গিয়েছে। কাজেই কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, খাগড়াগড়ের বাড়িটির যে অংশে বিস্ফোরণ হয়েছে,তার কিছুটা দূরেই, ঘরের অন্য দিকে পাওয়া গিয়েছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট দিয়ে তৈরি বিস্ফোরক ‘পাওয়ার জেল’-এর একটি বড় প্যাকেট। খনি বা খাদানে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাতে ওই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। প্যাকেটটি ‘সিল’ করা ছিল। বিস্ফোরণের এতটুকু আঁচ ওই প্যাকেটের গায়ে পড়েনি। পড়লে গোটা দোতলা বাড়িটি স্রেফ উড়ে যেতে পারত বলে এক তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বিস্ফোরণস্থল থেকে মিলেছে আর এক উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক অ্যাসিটোন পারক্সাইড। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, শরীরে বিস্ফোরক বেঁধে আত্মঘাতী হামলায় অনেক ক্ষেত্রেই এই বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহার হয়েছে আইইডি তৈরিতেও। আশ্চর্যজনক ভাবে খাগড়াগড়ের বাড়ি থেকে অ্যাসিটোন পারক্সাইড ভর্তি পাঁচ লিটারের জারটিও মিলেছে অক্ষত অবস্থায়।
তদন্তকারী এক অফিসার বলেন, “খেলনা দিয়ে আইইডি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণ হয়েছে বলেই বিস্ফোরণটি ছিল অল্প মাত্রার। না হলে ওই ঘরে মজুত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক গোটা বাড়িটাকেই উড়িয়ে দিত। একটাও দেশি গ্রেনেড কোনও
ভাবে ফাটলে পরিণাম হত ভয়াবহ। তার চেয়ে কম মাত্রার বিস্ফোরণ হয়েছে।” ওই অফিসারের মতে, নিহত দু’জনই বিস্ফোরক বা আইইডি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।
বলিউডের ছবিতে ২৭ বছর আগে দেখা গিয়েছে খেলনা বোমার ভয়ঙ্কর চেহারা। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবিতে পুতুল ভেবে ছোঁয়া মাত্র তীব্র বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ফুটফুটে এক শিশুকন্যা। আবার বিস্ফোরক ঠাসা, রিমোট-চালিত পুঁচকে খেলনা রোবট থানায় ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, এমনও দেখা গিয়েছে হিন্দি ছবিতে।
বর্ধমানের উপকণ্ঠে বসে এই ধরনের মারণ-খেলনা তৈরির বরাত কে বা কারা দিয়েছিল, কোথায় নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে দিয়েছিল, তা খুঁজে বের করাই এখন গোয়েন্দাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy